ঘুম থেকে উঠেই ব্যথায় মুখ বিকৃত করে বিছানায় বসে পড়লেন সুবিনয়। নিয়মিত হাঁটা-চলা, পরিমিত আহারে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখলেও কোমরের ব্যথাটা কিছুতেই কমছে না। শিরদাঁড়ায় ব্যথা যেন বাঙালির চিরকালের সঙ্গী। ছোটবেলার ফুটবল খেলার পুরনো চোট কী, ‘বুড়ো বয়সের ব্যথা’, সকলের আগে আক্রান্ত হয় সেই কোমরই। সঙ্গত করে ঘাড়। এর ফলে হাঁটাচলা ও স্বাভাবিক কাজকর্মও হয়ে ওঠে সমস্যাজনক।
এই শিরদাঁড়ার ব্যথার একাধিক কারণের মধ্যে অন্যতম ডিস্ক হার্নিয়েশন, যাকে সহজ করে স্লিপড ডিস্কও বলেন কেউ কেউ।
কাকে বলে ডিস্ক হার্নিয়েশন?
আমাদের শিরদাঁড়া অনেক কশেরুকার সমষ্টি। মানবদেহে মোট ৩৩টি, মতান্তরে ২৬টি কশেরুকা থাকে। এই কশেরুকাগুলি পরস্পরের উপরে উল্লম্ব ভাবে সজ্জিত থাকে। দু’টি কশেরুকার মাঝখানের অস্থিসন্ধিতে থাকে গোলাকার চাকতির মতো একটি অংশ। এগুলিকে ডিস্ক বলা হয়। এগুলি মূলত জেলিসদৃশ একটি বস্তু দিয়ে গঠিত। এই ডিস্কগুলিকে কশেরুকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে অ্যান্টেরিয়র লংগিটিউডিনাল লিগামেন্ট, পস্টেরিয়র লংগিটিউডিনাল লিগামেন্ট। অ্যান্টেরিয়র লিগামেন্ট অত্যন্ত শক্তপোক্ত হলেও পস্টেরিয়র লিগামেন্ট খানিকটা দুর্বল হয়। মানুষ দুই পায়ে হাঁটে, তাই শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে মেরুদণ্ডের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ডিস্ক বা চাকতিগুলি মূলত মেরুদণ্ডের ‘শক অ্যাবজ়র্ভার’ হিসেবে কাজ করে।
যখন পস্টেরিয়র লিগামেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ডিস্ক নিউক্লিয়াস স্পাইনাল ক্যানালে বেরিয়ে আসে, তাকে বলা হয় ডিস্ক হার্নিয়েশন, বা সহজ ভাষায় স্লিপড ডিস্ক।
কী ভাবে হয় ডিস্ক হার্নিয়েশন?
আমাদের কশেরুকার মধ্যে যে ডিস্ক থাকে সেটি নিউক্লিয়াস জেলির মতো। বয়স যত বাড়তে থাকে সেই জেলির মতো অংশটি শুকিয়ে কাঁকড়ার মাংসের মতো হয়ে যেতে থাকে। বলা হয় দু’টি ডিস্কের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে গিয়েছে বলে ব্যথা হচ্ছে। আদতে যেটা হয় সেটা হল ডিস্কের নিউক্লিয়াস যত শুকিয়ে যেতে থাকে, ততই দু’টি হাড়ের মধ্যে দূরত্ব কমতে থাকে। তার পর অপেক্ষাকৃত দুর্বল পস্টেরিয়র লিগামেন্টকে সরিয়ে বা ছিঁড়ে ডিস্ক কশেরুকার মধ্য থেকে বেরিয়ে যায়। শুরু হয় ব্যথা। ঘাড় আর কোমরের অংশে বেশি নড়াচড়া হয় বলে এই দুই অংশেই ডিস্ক হার্নিয়েশনের সম্ভাবনা বেশি। ঘাড়ে সমস্যা হলে ব্যথা কাঁধ হয়ে হাত পর্যন্ত পৌঁছয় আর কোমরে সমস্যা হলে ব্যথা বা অবশ ভাব পা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
ডিস্ক হার্নিয়েশনের উপসর্গ কী?
কশেরুকার মধ্যে ডিস্ক ঠিক জায়গায় না থাকার তিন প্রকার উপসর্গ রয়েছে:
• আক্রান্ত স্থানের চার পাশের স্নায়ু আহত ও উত্তেজিত হওয়ায় শুরু হয় অসহ্য ব্যথা। একে লোকাল পেন বা মেকানিকাল পেন বলা হয়।
• শিরদাঁড়ার দু’পাশ থেকে যে স্নায়ু বেরিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে, ডিস্ক হার্নিয়েট করলে কোনও এক দিকের স্নায়ুকে চাপ দিতে থাকবে। সেই স্নায়ু যদি হাতে যায়, তবে সেই কারণে শুরু হবে হাতে ব্যথা। যদি পায়ে যায় তা হলে শুরু হবে পায়ে ব্যথা। একে বলা হয় র্যাডিকুলাপ্যাথি।
• যদি ডিস্ক হার্নিয়েট করে সরাসরি স্পাইনাল কর্ডকে চাপ দেয়, তা হলে যে যন্ত্রণা হয় তাকে বলা হয় মায়ালোপ্যাথি। চূড়ান্ত অবহেলা ও ঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে পায়ের কোনও অংশে পক্ষাঘাত বা মল-মূত্র ত্যাগের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ চলে যেতে পারে।
কাদের হতে পারে এই রোগ?
চোট আঘাতের ফলে ডিস্ক হার্নিয়েশনের সম্ভাবনা থাকে। বেকায়দায় আঘাত পাওয়া, ভারী কিছু তুলতে গিয়ে চোট পাওয়া খুবই পরিচিত কারণ। তবে এটি মূলত ডিজেনারেটিভ ডিজ়িজ় অর্থাৎ বয়সজনিত অসুখ। মেরুদণ্ড সংলগ্ন পেশি দুর্বল থাকলে বা বেশি বয়সে হাড় ক্ষয়ে পেশি দুর্বল হওয়ায় সামান্য চাপ পড়লেই ডিস্ক স্থানচ্যুত হতে পারে। ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে স্লিপড ডিস্কের। মেয়েদের তুলনায় বেশি সমস্যা দেখা দেয় পুরুষদের। বিশেষ করে যারা টানা বসে ডেস্ক ওয়ার্ক করেন বা ভারী জিনিস তুলতে হয়, তাঁদের মধ্যেই ডিস্ক হার্নিয়েশনের প্রবণতা দেখা যায়। ৫০-এর পরে দেখা যেতে পারে ডিস্ক হার্নিয়েশন সংক্রান্ত অন্য সমস্যা।
এই রোগের আর একটা রিস্ক ফ্যাক্টর হল ওবেসিটি বা বাড়তি ওজন। তাই আক্রান্ত রোগীদের ওজন কমানোর পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।
ডিস্ক হার্নিয়েশনের চারটি ধাপ হয়, ডিস্ক পোর্ট্রুশন, প্রোল্যাপসড ডিজ়িজ়, ডিস্ক এক্সট্রুশন ও সিকোয়েস্টারড ডিস্ক। ডিস্ক
এক্সট্রুশন ও সিকোয়েস্টারড ডিস্ক হল হার্নিয়েশনের চূড়ান্ত অবস্থা।
নিরাময় সম্ভব কী ভাবে?
এই অসুখের চিকিৎসা নির্ভর করে উপসর্গ ও কতটা যন্ত্রণা তার উপরে। যদি লোকাল বা মেকানিকাল পেন হয়, তা হলে চিকিৎসকরা কনজ়ারভেটিভ তথা চিরাচরিত প্রথায় চিকিৎসা করেন। অর্থাৎ অপারেশন ছাড়া চিকিৎসা করা হয় (নন-অপারেটিভ ম্যানেজমেন্ট)। এর মধ্যে পড়ে ফিজ়িয়োথেরাপি ও ওষুধ। চিকিৎসার পরিভাষায় এই ওষুধ প্রয়োগের চিকিৎসাকে বলা হয় সিম্পটম্যাটিক রিলিফ। যখন ধারণা করা হয় যে স্বাভাবিক ভাবেই হার্নিয়েশন ঠিক হয়ে যেতে পারে। বা আক্রান্ত ব্যক্তির হার্নিয়েশন চূড়ান্ত পর্যায়ে যায়নি, তখন তাকে বিশ্রামে থাকার উপদেশের সঙ্গে সঙ্গে আরাম দেওয়ার জন্য ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। তার সঙ্গে ফিজ়িয়োথেরাপির মাধ্যমে মেরুদণ্ডের পেশিকে দৃঢ় করার পরামর্শও দেওয়া হয়।
ব্যথা মারাত্মক হলে বা র্যাডিকুলোপ্যাথির সমস্যা বাড়লে পেন-ম্যানেজমেন্ট ট্রিটমেন্ট করানো হয়। কিন্তু মারাত্মক স্লিপড ডিস্ক, মাংসপেশি ও স্পাইনাল কর্ডের চূড়ান্ত দুর্বলতা (মায়ালোপ্যাথি) থাকলে সার্জারির কথা ভাবা হয়। বিশেষ করে যদি দেখা যায় যে, রোগীর হাতে পায়ে জোর থাকছে না, হাতে ছোট-ছোট কাজ করতে (যেমন বোতাম লাগানো) সমস্যা হচ্ছে, আঙুলে ঝিঁঝি ধরছে ক্রমাগত, তখন সার্জারি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও উপকারি।
‘মানুষ’ হয়ে ওঠার জন্য শিরদাঁড়া যেমন প্রয়োজন, হেঁটে চলে জীবনধারণের জন্যও প্রয়োজনীয় দেহের এই অংশটি। একটু যত্ন ও সচেতনতা থাকলেই শিরদাঁড়ার আঘাতের সঙ্গে মোকাবিলা সম্ভব।
তথ্য সহায়তা: নিউরোসার্জন ডা. অমিতাভ চন্দ