সাধারণত একজন মানুষের হার্টবিট মিনিটে ৬০-১০০র মধ্যে থাকে এবং হৃৎস্পন্দনের একটা নির্দিষ্ট ছন্দ থাকে। কিন্তু হার্টের সঙ্কোচন-প্রসারণের সময় ও ছন্দের হেরফের স্বাভাবিক ঘটনা। তবে তার একটা মাত্রা আছে, সেটা কম-বেশি হলে চিকিৎসার প্রয়োজন।
অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনকে চিকিৎসার পরিভাষায় কার্ডিয়াক অ্যারিদমিয়া বলা হয়। হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কৌশিক চাকীর ব্যাখ্যা, ‘‘এ ক্ষেত্রে দুটো জিনিসে সমস্যা দেখা যায়— প্লাম্বিং এবং ইলেকট্রিকস। হার্ট প্লাম্বিং অর্থাৎ রক্তনালিতে ব্লক, যার ফলে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। তা নিয়ে সাধারণ মানুষ কিছুটা ওয়াকিবহাল হলেও, ইলেকট্রিক্যাল ফল্টস নিয়ে তেমন সচেতনতা দেখা যায় না। আর সেটাই মূলত অ্যারিদমিয়ার কারণ।’’
অ্যারিদমিয়ার নানা ভাগ
অ্যারিদমিয়া হার্টের উপরের প্রকোষ্ঠ অ্যাট্রিয়া বা নীচের প্রকোষ্ঠ ভেনট্রিকলসে দেখা দিতে পারে। অনেক সময়েই এই রোগের কোনও উপসর্গ দেখা যায় না। তবে কিছু ক্ষেত্রে বুক ধড়ফড়, মাথা ঝিমঝিম করা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা যায়। হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ সুনীলবরণ রায় অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনের কারণের বিশদ ব্যাখ্যায় বলছেন, ‘‘হৃৎস্পন্দন সাধারণত নিয়মিত এবং নির্দিষ্ট ছন্দে হয়ে থাকে। তবে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে তাল রেখে চলতে একটুআধটু অনিয়মিত হতে হয়, যেটাকে সাইনাস অ্যারিদমিয়া বলা হয়। এটা সুস্থ মানুষের লক্ষণ। পালস বা স্টেথোস্কোপ দিয়ে দেখার সময়ে এটা ঠিক বোঝা যায় না। গ্রাফিক্যালি রেকর্ড করার সময়েই ধরা পড়ে।’’
অ্যারিদমিয়ার দু’টি ভাগের কথা বললেন ডা. রায়। ব্র্যাডিঅ্যারিদমিয়া এবং ট্যাকিঅ্যারিদমিয়া। ‘‘হার্টরেট কমে যাওয়ার ফলে যে অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন হয়, সেটা সাধারণত হার্টব্লক থেকে হয়ে থাকে। একেই আমরা বলি ব্র্যাডিঅ্যারিদমিয়া। এ ক্ষেত্রে হৃৎস্পন্দন ৬০-এর নীচে চলে যায়।’’ কারও জন্ম থেকেই এই সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু প্রথম দিকে ততটা বোঝা যায় না। হার্টরেট বেশ কমে গেলে শ্বাসকষ্ট, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা যায়, তখনই সমস্যা ধরা পড়ে। যে কোনও বয়সেই এই সমস্যা হতে পারে।
হার্টের ভিতরে ইলেকট্রিক্যাল ইমপালস গেলে তবে হার্ট সঙ্কুচিত হয়। এই ইলেকট্রিক্যাল ইমপালস যেখানে তৈরি হয়, সেই জায়গার যদি গন্ডগোল থাকে তা হলে হার্টরেট কমে যেতে পারে এবং হাঁপিয়ে যাওয়া, মাথা ঘোরার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। ওষুধে কাজ না হলে পেসমেকার বসাতে হতে পারে।
‘‘ট্যাকিঅ্যারিদমিয়া হল, যেখানে হার্টরেট ১০০র উপরে চলে যায়। আমাদের হার্টের যে স্বাভাবিক পেসমেকার থাকে সেটা মিনিটে ৭২ বার বিট করে। কিন্তু সেটাই চূড়ান্ত নয়। সাধারণত ৬০-১০০ বার বিট করে। ব্র্যাডি ও ট্যাকির মাঝে হৃৎস্পন্দনের মাত্রা থাকাটাই স্বাভাবিক,’’ বক্তব্য ডা. সুনীলবরণ রায়ের। ট্যাকিঅ্যারিদমিয়ারও ভাগ আছে। হার্টরেট বেড়ে যাওয়ার মধ্যে কমন হল অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন। বয়সের সঙ্গে অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশনের প্রবণতা বাড়ে। অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশনের কারণে প্যারালিসিসের সম্ভাবনা বেড়ে যায়, জানালেন ডা. সুনীলবরণ রায়।
ট্যাকিঅ্যারিদমিয়ার আর একটি ভাগ হল সুপ্রা ভেন্টিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া— হার্টরেট বেশি কিন্তু নির্দিষ্ট ছন্দে চলছে। এখানে রেট ১৮০ পর্যন্ত ওঠে যায়। এ সব ক্ষেত্রে ওষুধেই চেষ্টা করা নয়তো শক দিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হয়। অন্য দিকে ভেন্টিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া হল জটিল সমস্যা। হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়ার ঘটনার পিছনে এই সমস্যাই বেশি দেখা যায়। ডা. রায় বলছেন, ‘‘একটা অ্যাটাকের পরে হার্টের পাম্পিং ফাংশন কমে গেলে (৩৫-এর নীচে) ভেন্টিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। প্রথমে ওষুধ, শক থেরাপি দিয়ে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তাতে নিরাময় সম্ভব না হলে, বিশেষ ধরনের পেসমেকার (আইসিডি) বসানোর কথা বলে থাকি আমরা।’’
কেন হয় এই ধরনের সমস্যা
ডা. কৌশিক চাকী বলছেন, ‘‘অনেক সময়ে জন্ম থেকেই সমস্যা থাকে। হার্টের যে দেওয়াল ডান ও বাঁ দিকের প্রকোষ্ঠকে আলাদা করে, সেই দেওয়ালে জন্ম থেকেই ফুটো থাকে অনেকের। একে কগনিজেন্টাল হার্ট ডিফেক্টস বলা হয়। তা ছাড়া হরমোনাল সমস্যা, স্ট্রেস, অ্যাংজ়াইটি, অতিরিক্ত ধূমপান... এ সব কারণেও অনিয়মিত ও দ্রুত হৃৎস্পন্দন হতে পারে।’’ অন্য কোনও রোগের কারণেও এই সমস্যার সূত্রপাত হতে পারে। যেমন রক্তচাপজনিত সমস্যা, ডায়াবিটিস বা অতীতে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনকে অবহেলা করা উচিত নয়। সমস্যা বেড়ে গিয়ে মৃত্যুও ঘটতে পারে।
সমস্যার উপসর্গ
যতক্ষণ না কোনও উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, ততক্ষণ এই সমস্যা ধরা পড়ে না। বুক ধরফর করা, শরীর কাঁপা, মাথা ঘোরা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, দু্র্বলতাক মতো উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। ইসিজি, হল্টার মনিটরিং, লুপ রেকর্ডার, ইকোকার্ডিয়োগ্রাফ এবং কিছু রক্ত পরীক্ষায় মাধ্যমে বোঝা যাবে ঠিক কী সমস্যা হয়েছে।
কোন পথে নিরাময়
ওষুধ, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্ভব। যাঁদের ইরেগুলার হার্টবিট তাঁরা ক্যাফেন, এনার্জি ড্রিংক, অ্যালকোহল, সিগারেট, প্রসেসড ফুড, রেড মিট খাদ্যতালিকার বাইরে রাখবেন। অতিরিক্ত চিনি বা নুন খাওয়াও ভাল নয়। যাঁরা অ্যাথলিট বা নিয়মিত শারীরচর্চা করেন, তাঁদের কারও এমন সমস্যা থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। ডা. চাকী বলছেন, ‘‘দুর্বল হার্ট এবং তার সঙ্গে দ্রুত ও অনিয়মিত হার্টবিটের সমস্যা থাকলে একটি বিশেষ ডিভাইস অটোমেটিক ইমপ্লান্টেবল কার্ডিয়োভার্টার-ডিফিব্রিলেটর (এআইসিডি) বসানো পরামর্শ আমরা দিয়ে থাকি। অন্য দিকে যদি অনিয়মিত এবং কম হার্টবিট হয় আর রোগী মাঝেমধ্যেই অজ্ঞান হয়ে যায়, তা হলে পেসমেকার বসাতে হতে পারে।’’
এই রোগ ধরা পড়তে সময় নেয়। বুকে ব্যথা, মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা বারবার হতে থাকলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত।