পালাবদলের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে রাজ্যের তথ্য সংস্কৃতি দফতর তুলে ধরে ছিল জঙ্গলমহলের হাসি মুখের ছবি। তবে, হাসির বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে স্বাস্থ্য দফতরের সাম্প্রতিক রিপোর্ট।
গত মে মাসে, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ২৩ ব্লক জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আদিবাসী প্রভাবিত জঙ্গলমহলের যে রিপোর্ট স্বাস্থ্য ভবনে গিয়েছে, তাতে পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বাঁকুড়া জেলাতেই ২০১৪-১৫ সালে শিশু-মৃত্যুর সংখ্যা ২৭০০ ছাড়িয়েছে। সঙ্গে প্রসূতি-মৃত্যুর সংখ্যাও শতাধিক। জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, সরকারি ওই পরিসংখ্যান ছাড়াও, জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মৃত্যু হয়েছে বহু সদ্যোজাতের। সম্প্রতি এ ব্যাপারে শাসক দল তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হন সিপিএমের বিধায়য়ক রামেশ্বর দলুই। বিধানসভার উল্লেখ পর্বে তিনি শিশুমৃত্যুর প্রসঙ্গ তুলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য দাবি করেছেন।
এ ব্যাপারে, জঙ্গলমহল এলাকার এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, ‘‘সরকারি প্রতিশ্রুতি আর প্রয়োগের মাঝে যোজন দূরত্ব এখনও মোছা যায়নি। জঙ্গলমহলের স্বাস্থ্যোদ্ধার তাই নিছকই খাতায়-কলমে।’’
সরকার গঠনের বর্ষপূর্তির পরে বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে গিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রীও বার বার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন—‘‘জঙ্গলমহলে মাওবাদী অত্যাচার মুছে দিয়েছি।’’ ঘোষণা ছিল, জঙ্গলমহল এখন হাসছে। দু’টাকা কেজি দরে চাল, একশো দিনের কাজ, কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামে ‘কমিউনিটি হল’ গড়ে, সরকার তাদের জঙ্গলমহল উন্নয়ন-প্যাকেজ তুলে ধরে। বিরোধীরা বলছেন, যার অধিকাংশই কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প।
সরকারে এসে বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের মাওবাদী প্রভাবিত ব্লকগুলির স্বাস্থ্য ফেরাতে অধিকাংশ হাসপাতালে এসএনসিইউ এবং এসএনএসইউ গড়ার প্রস্তাব দিয়েছিল রাজ্য সরকার। গ্রামীণ মানুষের চিকিৎসার জন্য জেলা কিংবা মহকুমা সদরে আসার অসুবিধা দূর করতে চালু হয়েছিল ভ্রাম্যমাণ অ্যম্বুল্যান্স পরিষেবা। ঝাড়গ্রামকে আলাদা স্বাস্থ্য জেলা বলে ঘোষণা করে সেখানকার নিছক মহকুমা হাসপাতালটি ঢেলে সাজিয়ে তোলার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে বিরোধীরা বলছেন, স্বাস্থ্যোদ্ধারের সে চেষ্টা প্রতিশ্রুতির ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়। অ্যাম্বল্যান্স পরিষেবা শিকেয়, এসএনসিইউ সব জায়গায় হয়নি। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, জঙ্গলমহলের ব্লক হাসপাতালগুলিতে খান কয়েক শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়া কার্যত আর কিছুই হয়নি। ‘‘শিশু-মৃত্যুর হার তাই কোনও ভাবেই ঠেকানো যায়নি,’’ মন্তব্য বাঁকুড়া হাসপাতালের এক স্বাস্থ্যকর্তার।
সরকারি ওই রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, ২০১২-১৩ সালে ওই জেলায় শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৬৪৫। পরের বছর (২০১৩-১৪) সালে সেই পরিসংখ্য়ান ১২৭৭। এ বছর তা ১০৯৩। এই জেলায় শিশু-মৃত্যুর হার গড়ে প্রতি হাজারে ২১-২৭ জন। যার অধিকাংশই দক্ষিণ বাঁকুড়ার সারেঙ্গা, সিমলাপাল, রাইপুর এবং রানিবাঁধ ব্লকে। জঙ্গলমহলের ওই চার ব্লকে প্রসূতি-মৃত্যুর সংখ্যাও একশোর বেশি বলে জানা গিয়েছে।
বাঁকুড়ার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রসূনকুমার দাস বলছেন, ‘‘গ্রামীণ মানুষের বিশেষত জঙ্গলমহলে স্বাস্থ্য পরিষেবা ফেরাতে আমরা বিবিধ চেষ্টা চালাচ্ছি।’’ প্রায় একই সুরে পশ্চিম মেদিনীপুরের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরা বলছেন, ‘‘চেষ্টার ত্রুটি নেই স্বাস্থ্য দফতরের তবে অনেক সময়ে প্রসূতিরা আসেন একেবারে শেষ সময়ে। তখন আর কিছু করার থাকে না।’’ চলতি বছরে ওই জেলায় সরকারি ভাবে ১৬০৭ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। যার অধিকাংশই পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলের আওতাধীন ১১টি ব্লকে। এক স্বাস্থ্য কর্তার আক্ষেপ, ‘‘জঙ্গলমহলে শিশু-মৃত্যু মূল কারণ অপুষ্টি। জঙ্গলমহল এখনও ঘোর অপুষ্টিতে ভুগছে। ফলে শিশু-মৃত্যুর হারও কমছে না।’’
জঙ্গলমহল কি এর পরেও হাসছে, প্রশ্ন এখন সেটাই।