Eid 2025 Recipes

ইদের চাঁদ দেখলেই মেয়েরা ঢোকেন হেঁশেলে, শুরু হয় রান্নার প্রস্তুতি, ও পার বাংলার গল্প বললেন রন্ধনশিল্পী

সকলে মিলে আনন্দ করার দিন। ইদ কখনও কেউ একা পালন করেন না। বাংলাদেশে আসার পর থেকেই দেখেছি, ইদের দিন একটা গোটা জাতিই যেন সমষ্টিগত ভাবে প্রাণশক্তি ফিরে পায়। খাওয়া, খাওয়ানো আর উপহার দিয়ে অতিথি আপ্যায়নেই আনন্দ।

Advertisement
নয়না আফরোজ

নয়না আফরোজ

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২৫ ১০:৪২
Share:
Chef-recommended simple and celebratory recipes for Eid-al Fitr 2025

ও পার বাংলায় ইদ পালনের গল্প, সঙ্গে রকমারি রান্না শেখালেন রন্ধনশিল্পী নয়না আফরোজ। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

এক মাস সারা দিন উপোস করে, রমজান পালন করে তার পর খুশির ইদ আসে। নতুন পোশাক পরে সকাল থেকে ইদগাহে সব বয়সের মানুষের ভিড়, ইদের নমাজ পড়া। তার পর আত্মীয়, প্রতিবেশীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়। সারা দিন চলে মিষ্টিমুখ। টেবিলের উপর থালা সাজিয়ে থরে থরে রান্না পরিবেশন করেন বাড়ির মহিলারা। চেনা হোক, স্বল্পপরিচিত হোক, সকলের জন্যই সে দিন বাড়িতে দোর খোলা। সকলেরই সাদর আমন্ত্রণ। অতিথি এলেই তাঁকে দু’দণ্ড জিরিয়ে খাবার খেয়েই যেতে হবে। থালা-বাটি সাজানোই থাকবে। নিজের মনের মতো খাবার থালায় তুলে বসে যেতে হবে খেতে। এটাই রীতি। বিয়ের পর থেকে এমনটাই দেখে আসছি।

Advertisement

ঐতিহাসিক ভাবে বাংলাদেশের ‘ইদ’ যতটা ধর্মীয়, তার চেয়ে অনেক বেশি উৎসবের। সেখানে ধর্মের ভেদাভেদ নেই। অসাম্প্রদায়িক, ভেদাভেদহীন এক সেতুবন্ধন। ধর্মীয় তত্ত্বে ইদ অত্যন্ত পবিত্র ধর্মীয় উৎসব। তবে ও পার বাংলায় তা যেন মধুর রসে সিক্ত এক জাতীয় আনন্দোৎসব। সকলে মিলে আনন্দ করার দিন। ইদ কখনও কেউ একা পালন করেন না। বাংলাদেশে আসার পর থেকেই দেখেছি, ইদের দিন একটা গোটা জাতিই যেন সমষ্টিগত ভাবে প্রাণশক্তি ফিরে পায়। কেবল নিজের আত্মীয়-বন্ধুরা নন, আশপাশের বাড়ি, অন্য পাড়া, অন্য এলাকা থেকেও লোকজন এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে যান। ঘরে এসে খাবার খেয়ে যান। বাড়ির মহিলারা শতাধিক মানুষের জন্য রাঁধতেও ক্লান্তিবোধ করেন না। রাতভর চলে রান্না। আর সকালের নমাজ শেষের পরই শুরু হয় খাওয়া আর খাওয়ানো।

চাঁদের নামে এ রাতের নাম হয়ে যায় ‘চাঁদরাত’। ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় ঘরে-বাইরে, বিশেষ করে অন্দরমহলে। ইদের নমাজে সব বয়সের পুরুষেরা ধর্মীয় রীতি মেনে নতুন বা পরিষ্কার পোশাক-টুপি পরে, আতর লাগিয়ে নমাজে শামিল হন। চাঁদ দেখেই শহর সেজে ওঠে আলোকমালায়। আর ও দিকে ব্যস্ততা শুরু হয় হেঁশেলে। চাঁদরাতেই রান্নার উপকরণ গুছিয়ে কিছুটা কাজ এগিয়ে রাখেন বাড়ির মহিলারা। ইদের খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয় বিশাল। পোলাও, বিরিয়ানি, সুগন্ধি ভাত থাকবে কয়েক রকম, সঙ্গে তিন থেকে চার রকম ভাবে রাঁধা মাংস। মিষ্টির মধ্যে সেমাই, হালুয়া থাকবেই। উচ্চবিত্তরা পঞ্চাশ থেকে ষাট রকমের পদও রেঁধে সাজিয়ে দেন। আর্থিক ভাবে যাঁরা পিছিয়ে, তাঁরাও কিন্তু অতিথি আপ্যায়নে পিছপা হন না। চার রকম না হলেও এক রকম মাংস, পোলাও বা বিরিয়ানি রান্না হবেই বাড়িতে। আর সঙ্গে থাকবে ডিমের নানা পদ।

Advertisement

এখানে একটা মজার ঘটনা বলি। এ পার বাংলার কোনও বাঙালি বাড়িতে ভোজের দিন যেমন শুক্তো, ডাল, মাছের কিছু পদ থাকেই, ও পার বাংলায় ইদের দিন কিন্তু সে সবের বালাই নেই। নানা রকম মাংস ও ডিম থাকতেই হবে পাতে।

আমি কলকাতার মেয়ে। বাংলাদেশের মেহেরপুরের বৌমা। প্রথম বিয়ের পরে গিয়ে অত জানতাম না তাই। অতিথিদের জন্য মাংসের চার রকম পদ, পোলাও, বিরিয়ানি, নানা রকম মিষ্টি, হালুয়া রেঁধে যখন টেবিলে সাজাচ্ছি, শাশুড়িমা বললেন, “জামাইরা আসবে, আর তুমি ডিম রাঁধোনি। এ কী কথা!” ডিমও যে এ দিনের ভোজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি খাবার, তা পরে বুঝেছিলাম। ডিম দিয়ে ঝাল-ঝোল তো বটেই, ডিমের মিষ্টি বানানোও শুরু করি এর পরে। গতানুগতিক মিষ্টির পাশাপাশি, নিজের ভাবনায় আরও অনেক রকম মিষ্টি তৈরি করেছি। ঠিক যেমন রেঁধেছিলাম ডিম জর্দা। প্রণালী কঠিন নয়। একটু বুঝিয়ে বলি।

ডিম জর্দা

উপকরণে যা যা লাগবে

৬টি ডিম

১ কাপ চিনি

১ কাপ দুধ

১/৪ কাপ ঘি

৩টি তেজপাতা

৪টি ছোট এলাচ

২টি দারচিনি

জাফরান প্রয়োজনমতো

পেস্তা সাজানোর জন্য

ডিম জর্দা। নিজস্ব চিত্র।

প্রণালী

ডিম ফেটিয়ে নিতে হবে। দুধের মধ্যে চিনি ভাল করে গুলিয়ে নিয়ে ফেটানো ডিমের মধ্যে দিয়ে দিতে হবে। এ বার একটা খুব সুন্দর মিশ্রণ তৈরি করে নিতে হবে। কড়াইয়ে ঘি গরম করে তাতে তেজপাতা আর গরমমশলা দিয়ে গন্ধ বার হলে এই মিশ্রণটি ধীরে ধীরে ঢেলে দিতে হবে। হালকা হাতে নেড়ে যেতে হবে যাতে কড়াইতে লেগে না যায়। দুধ টেনে গিয়ে তেল ভেসে উঠলে তা দেখতে অনেকটা বোঁদের মতো লাগবে। এ বার উপর থেকে জাফরান মেশানো ঘি ছড়িয়ে নামিয়ে নিতে হবে। পেস্তা, বাদাম ছড়িয়ে পরিবেশন করতে হবে।

ইদের দিনে মিষ্টির কদর একটু বেশিই। ডিম জর্দা যেমন একটি মিষ্টি, তেমনই সেমাই হয় অনেক রকমের। বিশেষ করে লাচ্ছা সেমাই। খুব তাড়াতাড়ি রান্না হয়ে যায়। আসলে ইদের দিন সকলেই চান অন্য রকম কিছু করতে। তবে শুধু আলাদা হলেই তো হবে না, হতে হবে সুস্বাদু ও চটপট তৈরি করা খাবার। ইদের সকালটা প্রায় সব বাড়িতেই চটপটি ছোলার মশলা খাওয়া হয়। এখন তো বেশির ভাগ মানুষই স্বাস্থ্যসচেতন। তাই সারা দিনের খাবারে পোলাও-কোর্মা যেমন থাকে, তেমনই স্বাস্থ্যকর খাবারও রাখা থাকে। রাত থেকেই ভিজিয়ে রাখা হয় ছোলা। চটপটি মশলা প্রায় প্রতি বাড়িতেই থাকে। ছোলার চাট খাওয়ার পর মিষ্টিমুখ করে তার পর দাওয়াতের ভোজ শুরু হয় ধীরে ধীরে। নানা রকম কবাব দিয়ে খাওয়া শুরু হয়। পোলাও, বিরিয়ানি তো থাকেই, রুটিও খান অনেকে। রাত অবধি চলতে থাকে খাওয়াদাওয়া। আর থাকে নানা রকমের ফল। এত রকম ফলের আয়োজন আর কোথাও দেখতে পাবেন না।

পোলাও বা বিরিয়ানি কিন্তু প্রায় সব বাড়িতেই রাঁধা হয়। ঝটপট বানানো যায় আর খেতেও খুব সুস্বাদু হয়, এমন একটি পোলাও আমি বানাই। ইদ বলে নয়, যে কোনও অনুষ্ঠানেও এই পোলাওটি রেঁধে সকলকে খাওয়াতে পারেন। উপকরণ দেখে আয়োজনটা সেরে রাখলেই হবে। রান্না হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি।

বেরেস্তা পোলাও

উপকরণ

৫০০ গ্রাম চাল

৪ চা চামচ পেঁয়াজ কুচি

৪ চা-চামচ সাদা তেল

১ চা-চামচ ঘি

৪টি তেজপাতা

৬টি ছোট এলাচ

৮টি লবঙ্গ

২ ইঞ্চির মতো দারচিনি

১ চা-চামচ আদা বাটা

২ কাপ বেরেস্তা

১০টি কাঁচা মরিচ

লবণ স্বাদমতো

বেরেস্তা পোলাও। নিজস্ব চিত্র।

প্রণালী

চাল ধুয়ে আধ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে ছেঁকে নিতে হবে। কড়াইয়ে তেল ঘি মিশিয়ে গরম করে তাতে তেজপাতা ও গোটা গরমমশলা ফোড়ন দিতে হবে। সুগন্ধ বার হলে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে ভাজতে হবে। পেঁয়াজ ভাজা হলে তাতে চাল দিয়ে লবণ ও আদা বাটা দিয়ে ভাল করে ভাজতে হবে। চাল ভাজা হয়ে গেলে তাতে চালের দ্বিগুণ গরম জল দিয়ে দিতে হবে। কাঁচা মরিচ ও এক কাপ বেরেস্তা দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে ঢাকনা দিয়ে রান্না করতে হবে যত ক্ষণ না চাল আর জল সমান সমান হয়। এই পর্যায়ে আরও কাপ কাপ বেরেস্তা ও ঘি ছড়িয়ে আঁচ কমিয়ে দমে বসিয়ে রাখতে হবে যত ক্ষণ না চাল সিদ্ধ হয়। রান্না হয়ে গেলে গরম গরম পরিবেশন করতে হবে।

দুপুরের জন্য যে যার বাড়ির সদস্যদের পছন্দ মত বিরিয়ানি,পোলাও,রেজ়ালা,মটন বা চিকেন চাঁপ, টিকিয়া, কবাব ইত্যাদি নানা রকম মাংসের পদ রাঁধেন। চার থেকে পাঁচ রকম মাংসের পদ থাকবেই। তার মধ্যে আমি একটি ইদ-স্পেশাল মাংস রাঁধি—খাসির কোর্মা।

খাসির কোর্মা

উপকরণ

দেড় কেজি খাসির মাংস

৪ ইঞ্চি দারুচিনি -

৮টি লবঙ্গ

৫-৬টি এলাচ থেঁতো করা

১০-১২টি গোলমরিচ

আধ চা চামচ জায়ফল-জয়িত্রী গুঁড়ো

১ চা চামচ পোস্ত বাটা

১ কাপ পেঁয়াজ কুচি

১ চামচ আদা বাটা

১ চামচ রসুন বাটা

১ চামচ ধনেগুঁড়ো

৫-৬টি কাঁচা মরিচ

আধ কাপ টক দই

১ চামচ লেবুর রস

আধ কাপ তেল

১/৪ কাপ ঘি

মটন কোর্মা। নিজস্ব চিত্র।

প্রণালী

মাংস বড় বড় টুকরো করে কেটে ধুয়ে জল ঝরিয়ে নিতে হবে। ম্যারিনেটের জন্য মাংসে আদা, রসুন, পেঁয়াজ বাটা, লবণ, টক দই, মিষ্টি দই মিলিয়ে এক ঘণ্টা রাখতে হবে। এ বার কড়াই চাপিয়ে তেল গরম হলে পেঁয়াজ কুচি ভাজতে হবে যত ক্ষণ না তাতে হালকা বাদামি রং ধরে। এ বার অর্ধেক গরম মশলা দিয়ে ম্যারিনেট করা মাংস ঢেলে ভাল ভাবে কষাতে হবে। একে একে দিতে হবে ধনেগুঁড়ো, পোস্ত বাটা। সামান্য জল দিতে হবে। মশলার সঙ্গে মাংস ভাল করে কষিয়ে নিয়ে গরম জল দিয়ে ঢেকে বসিয়ে দিতে হবে। জল ফুটে উঠলে বাকি গরম মশলা তাতে দিয়ে দিতে হবে। মাংস সিদ্ধ হয়ে ঝোল ঘন হয়ে এলে, ঘি, কাঁচামরিচ, গোলমরিচ গুঁড়ো, জায়ফল ও জয়িত্রী গুঁড়ো দিয়ে নাড়তে হবে। তেল ঘি উপরে ভেসে উঠলে মাংস নামিয়ে বেরেস্তা ছড়িয়ে পরিবেশন করতে হবে।

এই দিন সব বিদ্বেষ, রাগ-অভিমান ভুলে নতুন করে মিলিত হওয়ার দিন। নমাজ শেষ হলেই ইদের ময়দানে শুরু হয়ে যায় কোলাকুলি। ছোটরা বেরিয়ে পড়ে বাড়ি বাড়ি ইদের সালাম জানাতে। বাড়ির মহিলারা তাদের খাবার পরিবেশন করে আপ্যায়ন করেন। ছোট পরিবার যাঁদের, তাঁরা আত্মীয়-পরিজনদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ইদের শুভেচ্ছা জানান। যাঁদের বাড়িতে দাওয়াতের বড় নিমন্ত্রণ থাকে, তাঁরা ওই দিন সময় করে উঠতে না পারলে, অন্য কোনও দিন যান। তাই খুশির ইদ এক দিনের হলেও ইদের খুশি বিনিময়, উপহার বিতরণ চলতেই থাকে। প্রার্থনা করি, এই খুশি সমাজের সকল মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক। শান্তি বজায় থাকুক। আজকের ‘বদলে’ যাওয়া যুগে শান্তি যে বড্ড জরুরি!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement