শরীরের তাপমাত্রা সামান্য উঠল কি উঠল না অমনি খোঁজ পড়ল তাদের! পেটে একটু মোচড় দিল কি দিল না, ছুটলেন তাদের আনতে! এরা আপনার পছন্দের অ্যান্টিবায়োটিক। সাধারণ কিছু অসুখবিসুখ সারানোর চেনা ওষুধ। আসলে ভাবেন, ব্যস্ততার যুগে তিন-চার দিন ছুটির ফুরসত কই? তাই রোগের হানার শুরুতেই চার্জ করেন এ সব মোক্ষম অস্ত্র।
তার পর কয়েকটা অ্যান্টিবায়োটিকে অসুখ একটু সারলেই ব্যস, বাকি অ্যান্টিবোয়োটিকগুলো প্যাকেটবন্দি হয়েই পড়ে থাকে। ভারতীয়দের ঘরে ঘরে এই একই ছবি এ বার ভাবাচ্ছে তামাম চিকিৎসক মহলকে। তাতে ইন্ধন জুগিয়েছে বিশ্বের কিছু গবেষণাও। যখন তখন মুঠো মুঠো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে রাশ না টানলে কী ক্ষতি অপেক্ষা করছে জানেন?
কেবল ভারতে নয়, গোটা বিশ্বেই যখন ইচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কোর্স না শেষ করে মাঝ পথেই ওষুধ থামিয়ে দেওয়ার বদভ্যাস। আর এখানেই প্রমাদ গুনছেন চিকিৎসকরা। ‘সুপারবাগ’-এর হানায় চিন্তায় গবেষকরাও।
আপনার এই মুড়িমুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া, সেই ওষুধের নির্দিষ্ট কোর্সটি শেষ না করা, এইসবই ধীরে ধীরে ডেকে আনছে এই রোগকে, এমনটাই মনে করছেন চিকিৎসকমহল। ব্যস্ততার জীবনে এই অসুখ ডেকে আনার প্রবণতা নিয়ে চিন্তায় চিকিৎসকরাও।
শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী শক্তি নিয়েই হানা দিচ্ছে যে সব ব্যাকটিরিয়া, ‘ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল’ (ইসিডিসি)-এর গবেষকরা তাদের নাম দিয়েছেন ‘সুপারবাগ’! ইউরোপ মহাদেশে সুপারবাগের প্রকোপে প্রতি বছর ৩৩ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে!
ঠিক কী এই অসুখ? জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামীর মতে, অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাটাকেই আসলে মেরে ফেলছি আমরা। ঘন ঘন অ্যান্টিবায়োটিক পড়ায় অসুখের ভাইরাস বা ব্যাকটিরিয়াও সে সব অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে লড়াই করার জন্য নিজেদের বিবর্তিত করে নিতে পারছে।
সোজা কথায় ব্যাখ্যা করলে বলা যায়, অবৈজ্ঞানিক ভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে শরীর হারাচ্ছে জীবাণুর সঙ্গে যুঝে যাওয়ার ক্ষমতা। তাই আজকাল ভাইরাল ফিভার থেকে শুরু করে একটু অচেনা ব্যাকটিরিয়ার হানা রুখতে পারছে না শরীর। ফলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটছে।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ভাস্কর কুমার দাসের মতে, প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যাকটিরিয়া মারতে আর অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। অথচ ব্যাকটিরিয়া থেকে সংক্রমণ হলে তো অন্য কোনও উপায়ও নেই। তখন ওই সংক্রমণটিই চরম আকার ধারণ করছে।
‘ল্যান্সেট ম্যাগাজিন ইনফেকশস ডিজিজেস’ নামে একটি রিপোর্টে জানাচ্ছে যক্ষ্মা বা এইচআইভি-এর থেকে কিছু কম ভয়ঙ্কর নয় এই রোগ। এবং শুধু ইউরোপ নয়, সারা বিশ্বেই ধীরে ধীরে থাবা বসাচ্ছে এই রোগ। ভারতেও প্রায় প্রতি বছরই এমন কিছু ব্যাকটিরিয়াঘটিত অসুখের দেখা মেলে, যা প্রায় কোনও রকম অ্যান্টিবায়োটিকেই আয়ত্তে আসে না।
অ্যান্টিবায়োটিক থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলা ব্যাকটিরিয়ারা মোট পাঁচ ধরণের সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বলে মত চিকিৎসকদের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতি থেকে রোগী আক্রান্ত হন হাসপাতালের ভিতরে। এমন অনেক সংক্রমণ রয়েছে যেখানে অ্যান্টিবায়োটিকই শেষ কথা, সুপারবাগ সেই অ্যান্টিবায়োটিককে নিস্ক্রিয় করে দিচ্ছে।
তা হলে উপায়? চিকিৎসকদের মতে, অ্যান্টিবায়োটিক নির্ভর জীবন থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়। শুধু তা-ই নয়, অসুখের আক্রমণ এলেও অল্পেই চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ফেলা ও কোর্স শেষ না করার অভ্যাসে রাশ টানা অত্যন্ত জরুরি। নইলে সুপারবাগের শিকার হতে পারেন অজান্তেই।