ছবি: শুভদীপ সামন্ত।
হিন্দু ধর্মবিশ্বাসে দেবতার চেয়ে দেবীর পূজোই বেশি। সেই সব পূজো থেকে যে সব সামাজিক সংস্কারের প্রচলন, তার অনেকগুলিই নারীকেন্দ্রিক। অথচ সেই জাঁকজমকের ভরকেন্দ্রে থাকেন পুরুষ। এমনই এক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিতে এখন মেতে রয়েছে বাঙালি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা পড়লে বোঝা যায়, জামাইষষ্ঠী পালনে তাঁর বেশ রুচি ছিল। তাঁর চিন্তা ছিল, বিদেশি প্রথায় মজে গিয়ে তরুণরা বুঝি এই সমাজরীতিটি ভুলে যাবে। কিন্তু ভোলা দূরস্থান, এই কর্পোরেট সংস্কৃতিতেও জামাইষষ্ঠী দিব্যি বাঙালিয়ানাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
অতীতে নারীরা ছিলেন অন্তঃপুরচারিণী। জীবন কাটত স্বামীদের উপার্জনে, তাঁদের ভরসায়। তাই জামাইষষ্ঠীতে মেয়ের স্বামীকে তুষ্ট রাখার বাড়তি তাগিদ থাকত মায়েদের। কিন্তু এখনকার শিক্ষিত বৃত্তে বৌমারাও সুরোজগেরে, প্রতিষ্ঠিতা। স্বামী-স্ত্রীর রসায়ন অনেকটাই বদলেছে। তাই বহু দিন ধরেই রব উঠছে, জামাইষষ্ঠীর মতো বৌমাষষ্ঠীও চালু করা হোক। শাশুড়িমায়েরা বাড়ির বৌটিকেও একই ভাবে স্নেহ-আদরে ভাল রাখলে, আখেরে ছেলের জীবনটাই তো আরও মধুর এবং সংসার শান্তিময় হবে। জামাইষষ্ঠীর প্রাক্কালে আবার এই প্রস্তাব রাখার আগে, মনে করিয়ে দেওয়া যাক, এই দিনটি গোড়া থেকে জামাইদের ছিলই না। পুরাণ, গ্রামবাংলার নদী-নালা, উনিশ শতকের কলকাতার রাস্তায় অনেক ইতিহাস পেরিয়ে দিনটিতে জামাইদের আবির্ভাব।
গ্রীষ্মকালের অরণ্যষষ্ঠী
তার প্রমাণ জামাইষষ্ঠীর ব্রতকথাতেও। তার একেবারে শেষ অংশে জামাইদের উল্লেখমাত্র রয়েছে। গল্প অনুযায়ী, জীবনে বহু ঝড়ঝাপটা সওয়ার পর, দেবী এক বৌকে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল ষষ্ঠীতে অরণ্যষষ্ঠী ব্রতের নিয়মকানুন শিখিয়ে দিলেন। সে এ দিনে মেয়ে-জামাইকেও নেমন্তন্ন করল, জামাইয়ের কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে আম-কাঁঠালের বাটা দিল। সেই থেকেই এই দিন জামাইষষ্ঠী হিসেবেও পালিত হয়।
কিন্তু সে নিজের সাত ছেলের বৌদেরও ফোঁটা দিল, এমন তথ্য কোথাও নেই। তাই কি অরণ্যষষ্ঠীর দিনটা জামাইষষ্ঠী হয়ে গেল, আর বৌমাষষ্ঠীহল না?
ষষ্ঠী দেবীর সন্ধানে
প্রসঙ্গত, ষষ্ঠী কিন্তু লৌকিক দেবী নন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী তিনিই দেবসেনা, কার্তিকের ভার্যা। মাতৃকাদের মধ্যে প্রধানা। মহাভারত বলছে, গৃহে তাঁর মূর্তি রেখে তুষ্ট করলে সংসার সুখে-সন্তানে পূর্ণ থাকে। কোনও মতে, কৃত্তিকা-সহ যেছয় মাতৃকা কার্তিকেয়কে স্তন্যপান করিয়েছিলেন, তাঁদের সম্মিলিত মূর্তি। প্রসূতি ও শিশুদের রক্ষয়িত্রী।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, বাংলায় গ্রাম্যদেবতার পাশাপাশি শাস্ত্রীয় বা পৌরাণিক দেব-দেবীর ব্রতেও চল আছে। যেমন, ষষ্ঠীদেবী ‘পুত্র’দান করেন। শিশুর জন্মের পর এবং বছরে বারোটি ষষ্ঠী পালনের রেওয়াজ। যেমন লোটনষষ্ঠী, দুর্গাষষ্ঠী ইত্যাদি। জ্যৈষ্ঠ মাসের অরণ্যষষ্ঠীর নিয়মের সঙ্গে প্রকৃতি আরাধনার সাযুজ্য আছে। আগে এ ব্রত হত অরণ্যের মধ্যে বা বাড়িতেই দালানে অরণ্যের ছোট্ট প্রতিরূপ তৈরি করে।
জামাই এল বাড়িতে
ঔপনিবেশিক আমলে জামাইরা এই আসরের মধ্যমণি হয়ে উঠলেন। সাংসদ ও লেখক জহর সরকার বললেন, “আঠারো-উনিশ শতকে বাংলার সচ্ছল শ্রেণিতে বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহের ব্যাপক প্রচলন হয়, ফল বাল্যবিধবার যন্ত্রণাময় জীবন, বিস্তর সতীদাহ। এই অবস্থায় জামাই ও স্বামীর দীর্ঘ জীবন প্রার্থনা বাঙালি মা ও মেয়ের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।” এ দিকে, বিয়ের পর মেয়ের বাড়ি যাওয়ায় মা-বাবার উপরে ছিল বাধানিষেধ। এ দিনে জামাইকে নিমন্ত্রণ করলে, মেয়েও বাড়ি আসতে পায়। ঋতুটিও জামাই-আদরের উপযুক্ত। গাছে গাছে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, কামরাঙা, তালশাঁস। এর পর বর্ষা নামলে আসা-যাওয়া মুশকিল হবে। তখন বৃষ্টিতে মাছ ধরাও ঝকমারি। জহরবাবু আরও জানালেন, “জ্যৈষ্ঠ মাসেরই কৃষ্ণপক্ষে সাবিত্রী চতুর্দশীতে স্ত্রীদের যমের আরাধনা করে স্বামীর দীর্ঘজীবন কামনার পুরনো লোকাচারটির সূত্র ধরেই কলকাতার বাবু সংস্কৃতি শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীটি জামাইকে নিবেদন করেছিল।” রীতি মেনে তাকে বাতাস করা, হাতে বেঁধে দেওয়া হয় তেল-হলুদ মাখানো সুতো। তার দীর্ঘায়ু কামনার সঙ্গেই, এই সব উপহার, ভূরিভোজের মধ্য দিয়েই আজীবন চলতে থাকে পাত্রপক্ষের পণ-যৌতুক গ্রহণের উপচার।
পিতৃতান্ত্রিক প্রবণতাকেই ঢাল করে মাতৃতন্ত্রও তার প্রভাবটুকু বিছিয়ে দেয়। কন্যার স্বামীকেও সন্তানের স্থান দিয়ে সংসারটিকে একত্রে বেঁধে রাখেন স্নেহময়ী জননী। এটি জামাতাঠাকুরের বেকায়দায় পড়ারও দিন। সাহিত্যে এ দিনে শ্যালক-শ্যালিকা নিয়ে থিয়েটার দেখা, সন্ধেবেলা জামাই ঠকানোর রঙ্গতামাশার কথা আছে। প্রথম বাঙালি সবাক চলচ্চিত্র ছিল ‘জামাইষষ্ঠী’। সে নাকি কমেডি ছবি। আসলে এই অনুষ্ঠানে আশ্চর্য এক সাম্য আর সহাবস্থান লক্ষ করা যায়। বৈদিক ও লৌকিক দুই সমাজের সমন্বয় রয়েছে, আবার পিতৃতন্ত্রের অস্ত্রে তাকেই নাস্তানাবুদ করে মাতৃতন্ত্রের জয়গাথাও আছে।
আর বৌমার জন্য?
কিন্তু বিয়ের পর মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাতে আজ কোথায় বাধানিষেধ? যে যে কারণে জামাইষষ্ঠীর উৎপত্তি, তার অনেক কিছুই এখন অচল। অতীতে বিশেষ সঙ্কটের মোকাবিলা করতে অরণ্যষষ্ঠী যদি জামাইষষ্ঠীতে পালটে যেতে পারে, তবে একুশ শতকীয় পারিবারিক নকশায় এ বার তার পাশাপাশি বৌমাষষ্ঠী ঠাঁই পাবে না কেন? এমনিতেই তো জামাইষষ্ঠী এখন কিছুটা রেস্তরাঁ-ষষ্ঠী, আর কিছুটা অফিসের চাপে উইকেন্ড-ষষ্ঠী। বলা হত, ‘জামাই কাটে হাঁস, ঘরসুদ্ধ খায় বারো মাস’। তেমনই, মহাশয়ের সৌজন্যে একটু গেট টুগেদার। শ্বশুর-শাশুড়ি খবর চ্যানেল আর নেটফ্লিক্স নিয়ে ঝগড়া করবেন, জামাই অ্যাপে সুশি আনাবেন, নাতনি ট্যাঁকে কন্যেটি ইনস্টাগ্রামে রিল বানাবেন। তা ভালই। শুধু বৌমাষষ্ঠীটাও এ বার হল্লাহাটি করে শুরু হয়ে গেলে, আর একটা গেট টুগেদারের বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। সে দিক দিয়েও প্রস্তাবটা মন্দ নয়।
এবং বিনোদনের বেশে বিপ্লব এলে সমাজের মনটা সাফ করাও অনেক সহজ হবে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।