বিবি রাসেল। ছবি: সংগৃহীত।
বাংলাদেশের ভূমিসুতা। কাজের সূত্রে গোটা পৃথিবী চষে ফেলেছেন। কিন্তু কলকাতার সঙ্গে তাঁর প্রাণের টান। তিনি পোশাকশিল্পী বিবি রাসেল। বাংলার গামছা দিয়ে পোশাক বানিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন অনেক কাল আগেই। ‘বিবি আপার’ সৃষ্টি কখনও রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের কথা বলে, আবার কখনও মুখ হয়ে ওঠে বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য আর লোকায়ত সংস্কৃতির। তাঁর কাছে ফ্যাশন মানে উন্নয়ন। ফ্যাশন ইনস্টিটিউট ‘আইআইএফএম’ আয়োজিত একটি র্যাম্প শোয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সম্প্রতি শহরে এসেছেন তিনি। তার আগে জৈষ্ঠ্যের এক নিঝুম দুপুরে আনন্দবাজার অনলাইনের মোবাইল রেকর্ডারের সামনে নিজেকে মেলে ধরলেন পোশাকশিল্পী।
প্রশ্ন: ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে কত বছর হল?
বিবি: অনেক দিন। আমি পড়াশোনা করেছি ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে। মডেলিং করেছি। এখন পোশাকশিল্পী হিসাবে কাজ করছি। দেখতে দেখতে অনেক সময় পেরিয়ে এসেছি। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমার ফ্যাশন জগতের সঙ্গে সম্পর্ক।
প্রশ্ন: দীর্ঘ এই তিন দশকের সফর কেমন ছিল?
বিবি: আমি বাংলাদেশের মেয়ে। ছোট থেকেই আমার নতুন কিছু সৃষ্টির প্রতি ঝোঁক। আমরা বাংলা লিখতে পারব না যদি ব্যাকরণ না জানি। সব কিছুরই তো একটা ব্যাকরণ প্রয়োজন হয়। ফ্যাশনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সেটা শিখতেই লন্ডন পাড়ি দেওয়া।
প্রশ্ন: আপনি তো একটা সময় চুটিয়ে মডেলিং করেছেন!
বিবি: হ্যাঁ। লন্ডন থেকে ফেরার পরবর্তী জার্নিটা মডেলিংয়ের। মডেল হওয়া আমার স্বপ্ন ছিল না। তবে মডেলিংয়ের সূত্র ধরেই আমার বিশ্বভ্রমণ হয়েছে। আর অন্য কোনও কাজের ক্ষেত্রে এত অভিজ্ঞতা আমার হয়নি। বই পড়ে জানার চেয়ে চাক্ষুষ করার অনুভূতিই আলাদা। মডেলিং আমাকে পরিণত করেছে। পৃথিবীর তাবড় পোশাকশিল্পীদের সঙ্গে কাজ করে নিজেকে আরও বেশি মার্জিত করে তুলেছি।
প্রশ্ন: আপনার কাছে ফ্যাশনের সংজ্ঞা কী?
বিবি: এখন যেটা করছি, সেটা আমার ছোটবেলার স্বপ্ন। আমি তৈরি ইউরোপীয়ানদের হাতে। যদি শুধু ব্যবসা করার পরিকল্পনা থাকত, তা হলে দেশে ফিরতাম না। বিশ্বের দরবারে বাঙালি মেয়ে হয়ে নিজেকে চেনানো সহজ ছিল না। ফ্যাশন মানেই শুধু সাজ নয়। সমাজের অর্থনীতিও এর সঙ্গে জড়িত। আমি তাই বলি ‘উন্নয়নের জন্য ফ্যাশন’। বাংলাদেশে আমার তো কোনও দোকান নেই। কিন্তু ২০১৫ থেকে বিশ্বের সেরা ফ্যাশন ডিজাইনারদের তালিকায় আমার নাম রয়েছে।
প্রশ্ন: আপনার যে কোনও সৃষ্টি কিছু না কিছু বার্তা বহন করে। ফ্যাশন মানেই যে শুধু চাকচিক্য নয়। এই মন্ত্রেই কি দীক্ষিত আপনি?
বিবি: ফ্যাশন আসলে অনেক কিছুর মিশেল। চাকচিক্য থাকতে পারে। ফ্যাশনের ভাষা বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন প্রজন্মে বদলেছে। প্রত্যেকটি কাজের আগে আমার মাথায় থাকে, আমি কাদের ধরতে চাইছি। তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে ডিজিটাল মিডিয়ার সংযোগ খুব ঘনিষ্ঠ। ফলে বিশ্বের ফ্যাশন এখন হাতের মুঠোয়। তাই এমন কিছু সৃষ্টি করতে হবে, যা মন কাড়বে কমবয়সিদের। তাঁতের শাড়িকেও যদি একটু অন্য রকম ভাবে উপস্থাপন করা যায়, নতুন প্রজন্ম লুফে নেবে।
প্রশ্ন: তাঁতের কথা বলতে মনে পড়ল, তাঁত শিল্প ধীরে ধীরে নিজের অস্তিত্ব হারাতে শুরু করেছে। কারণ তাঁত শিল্পীদের পরবর্তী প্রজন্ম উচ্চশিক্ষার পথ বেছে নিচ্ছেন, যেটা স্বাভাবিক। এতে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি কোথাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি? কী বলবেন?
বিবি: তাঁত বোনার শিল্প থেকে মুখ ফেরানোর অন্যতম কারণ হতে পারে এখানে পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর অভাব। তা ছাড়া প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় এ কাজে। সব মিলিয়ে হ্যান্ডলুমও শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন এমন সব সুতো বাজারে আসছে, যেগুলির অধিকাংশ নকল।
প্রশ্ন: তরুণ প্রজন্ম সারাদিন সমাজমাধ্যমে প্রভাবীদের সাজ দেখছে। তাদের অনুকরণ করতে যখন-তখন অনলাইনে কেনাকাটা করছে। এই ‘ফাস্ট ফ্যাশন’ তো শুধু ব্যয়সাপেক্ষ নয়, পরিবেশেরও ক্ষতি করে। কমবয়সিদের জন্য কী পরামর্শ আপনার?
বিবি: আমারও পুরোটাই অনলাইনে। অনেক সময় অনলাইন কেনাকাটায় কাপড়টি সত্যিই হ্যান্ডলুম কি না, বোঝা যায় না। তবে আমার কাছে গ্রাহকের বিশ্বাস বজায় রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমি তো ব্যবসা করতে আসিনি। আমার সৃষ্টির স্বাদ যাতে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে, সেটাই চাই। এখনও পর্যন্ত আমার জিনিস নিয়ে কেউ অখুশি নন। কারণ, আমি এ বিষয়ে খুব সাবধান থাকি। বাংলাদেশ মানেই যে সব খারাপ জিনিস দেয় না, আমি এই ধারণাটা সকলের মনে গেঁথে দিতে চাই। গোটা পৃথিবী চলছে অনলাইনে। তবে আমি বলব কেনাকাটা হোক কিংবা যে কোনও বিষয়, সচেতন থাকা জরুরি।
ফ্যাশন মানে তাঁর কাছে সমাজের আর্থিক উন্নয়নের পথও। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: ১৩ বছর বয়স থেকেই আপনি সেলাইয়ে হাত পাকিয়েছেন। এখন কোনও মেয়ে সেলাই করছে মানে সেটাকে ভীষণ ‘ব্যাকডেটেড’ হিসাবে ধরা হয়। আগে স্কুলে সেলাই শিক্ষার আলাদা ক্লাস থাকত। ইদানীং সে সবও উঠে গিয়েছে। আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি এত এগিয়ে থাকলেও সাধারণের মধ্যে সেলাই নিয়ে এত অনীহার কারণ কী?
বিবি: এটা খুবই খারাপ। আমার প্রথাগত শিক্ষা বলতে আমি ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছি। সেলাই করেই তো স্বপ্নকে ছুঁয়েছি। আমি বাংলা আকাদেমির ফেলো। এ ছাড়াও দেশে-বিদেশে বহু পুরস্কার তো আছেই। যোগ্যতা থাকলে সেলাই করেও যে অনেক দূর পৌঁছনো যায়, সেটা আমি আমার দেশের মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করি।
প্রশ্ন: আপনার গামছা কালেকশন গোটা দেশে হইচই ফেলে দিয়েছিল। তার পর সে রকম ভাবে আপনার সৃষ্টি নিয়ে চর্চা হয়নি। এই দীর্ঘ বিরতি কেন?
বিবি: আমি সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে কাজ করতে ভালবাসি। তাড়াহুড়ো আমার পছন্দ নয়। তবে গামছা এখনও আমার বেস্ট সেলার। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্ত থেকেই মানুষ আসুক, বিবি রাসেলের একটা গামছা কেনেন। কিছু দিন আগে স্পেনে গিয়েছিলাম। সে দেশের রানি আমাকে বলেছেন, দেশ থেকে ফেরার সময়ে অন্যান্য পোশাকের সঙ্গে একটা গামছা কালেকশন আনতে। ফলে গামছা এখনও অত্যন্ত ট্রেন্ডে রয়েছে। অনেকেই পছন্দ করছেন।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রিতে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী আছে? প্রতিযোগিতায় বিশ্বাস করেন?
বিবি: প্রতিদ্বন্দ্বী তো থাকবেই। না থাকলেই বরং একঘেয়ে লাগে। কিন্তু কে আছে জানি না। তবে যদি কেউ এমন থেকে থাকেন, তাঁকে টপকে যাওয়ার শক্তি আমার আছে এখনও পর্যন্ত। আর প্রতিযোগিতাতেও আমি বিশ্বাস করি। চলার পথে এগোতে সুবিধা হয়। আমিই রাজা হলে তো খুব বোরিং। তবে আমার যা আছে, তাতে আমি মনে করি না এখনও পর্যন্ত তার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে। তবে নতুন প্রজন্মে নিশ্চয়ই কেউ হবেন।
প্রশ্ন: আপনার ফ্যাশন আইকন কে?
বিবি: রবীন্দ্রনাথ। আমার ওঁর মতো স্টাইলিশ কাউকে লাগে না। সারা জীবনে যত বার যেখানে গিয়েছেন, সাজগোজেও সেই ধারা বজায় রেখেছেন। জাপানে গিয়ে এক রকমের পোশাক, তুর্কিতে আবার অন্য রকম। দেখতেও তো অনেক সুন্দর ছিলেন। চুলগুলি কী দারুণ!
প্রশ্ন: দুই বাংলার কোন অভিনেত্রীর ফ্যাশন সচেতনতা আপনাকে আকৃষ্ট করে?
বিবি: কঙ্কণা সেনশর্মা আর সুদীপ্তা চক্রবর্তীর অভিনয় এবং ফ্যাশন নিয়ে ওঁদের ভাবনা আমার বেশ ভাল লাগে। জয়া আহসানকেও ভাল লাগে। আসলে সকলেই অনেক ভাল কাজ করছেন।