সচেতনতাই একমাত্র প্রতিষেধক

পয়লা ডিসেম্বর বিশ্ব এডস দিবস। এই রোগ নিয়ে নানা ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। সেগুলি দূর করে ঠিকমতো চিকিৎসা করালে এডস রোগীও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারেন। জানাচ্ছেন চিকিৎসক অতন্দ্র দাসপয়লা ডিসেম্বর বিশ্ব এডস দিবস। এই রোগ নিয়ে নানা ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। সেগুলি দূর করে ঠিকমতো চিকিৎসা করালে এডস রোগীও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারেন। জানাচ্ছেন চিকিৎসক অতন্দ্র দাস

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৮ ০২:০৫
Share:

রোগী দেখছেন চিকিৎসক। ছবি: উদিত সিংহ

প্রশ্ন: এইচআইভি বা এডস এই রোগটি আসলে কী?

Advertisement

উত্তর: এই রোগের পুরো নামটি হল অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম। যা রেট্রোভাইরাস পরিবারের অন্তর্গত। এর দু’টি ধরন আছে। সেগুলি হল, এইচআইভি -১ ও এইচআইভি-২। এর মধ্যে আমাদের দেশে এইচআইভি-২-এ আক্রান্ত রোগীই বেশি পাওয়া যায়।

Advertisement

প্রশ্ন: এই রোগটি হলে কী সমস্যা হয়?

উত্তর: এই রোগে আক্রান্ত হলে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। আর সেই কারণেই অন্যান্য জীবানুঘটিত রোগ খুব সহজেই শরীরে বাসা বাঁধে। তাঁদের মধ্যে টিউবার কিউলোসিস বা যক্ষ্মা, বিভিন্ন ছত্রাকঘটিত রোগ, যেমন ক্রিপ্টোকক্কাস, ক্যানডিডা অন্যতম। একই সঙ্গে স্নায়ুঘটিত কিছু রোগ এবং বিশেষ ধরনের কিছু টিউমার (যেমন- ক্যাপুসি, সারকোমা, নন হজকিন্স, লিম্ফোমা, মেয়েদের জরায়ু মুখের ক্যানসার, ছেলেদের পায়ুদ্বারে ক্যানসার) রোগ দেখতে পাওয়া যায়। এই ভাইরাস সংক্রমণের বৈশিষ্ট্য হল এরা মানব দেহে প্রবেশের পরে শরীরে মিশে গিয়ে ভাইরাল রিফ্লেকশনের মাধ্যমে নিজের সংখ্যা বাড়াতে থাকে। এই ভাইরাস দেহের লিম্ফয়েড কোষগুলিকে ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে শরীরে নানা সমস্যা দেখা দেয়।

প্রশ্ন: এই রোগের কি কি লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়?

উত্তর: এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে বেশ কিছু লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়। সেগুলি হল— ১) দ্রুত ওজন কমে যাওয়া, ২) বারবার জ্বর আসা, ৩) দুর্বলতা বেড়ে যাওয়া, ৪) বগল, কুঁচকি, গলার কাছে লিম্ফগ্লান্ড ফুলে যাওয়া, ৬) সাত দিনের বেশি সময় ধরে চলা ডায়েরিয়া, ৭) মুখ, যোনি, পায়ুদ্বারে ঘা এবং ৮) নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া। এই রোগে আক্রান্ত হলে উপরের সমস্যাগুলি দেখা দিতে পারে। এই সমস্যাগুলি দেখা দিলেই সবার আগে ডাক্তারের কাছে ছুটে যাওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে এই লক্ষণের পিছনে আসল কারণটি দ্রুত ধরা পড়বে।

প্রশ্ন: সাধারণ মানুষের মনে ধারণা রয়েছে, এই রোগ শুধু যৌন সম্পর্কের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়ে। সত্যিই কি তাই?

উত্তর: না, ধারণাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। অসুরক্ষিত যৌনজীবন এই রোগের অন্যতম কারণ হলেও অন্যান্য বেশ কিছু কারণে এই রোগের ভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন। সেগুলি হল— এইচআইভি ভাইরাসে সংক্রমিত সূচ দিয়ে মাদক দ্রব্য সেবন করলে, এইচআইভি ভাইরাসে সংক্রমিত কারও থেকে রক্ত নেওয়া হলে, সংক্রমিত গর্ভবতী মায়ের থেকে গর্ভস্থ শিশুর দেহে সংক্রমণ হতে পারে। তবে, এখন উন্নত পরীক্ষা ব্যবস্থার ফলে সংক্রমিত রোগীর রক্ত অন্য কোন রোগীর শরীরে প্রবেশের ঘটনা এখন নেই বললেই চলে। আর হ্যাঁ, এটা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্কের ফলে এই রোগ হতে পারে।

প্রশ্ন: সাধারণত এই রোগ নিয়ে নানা সংস্কার রয়েছে, অনেকেই মনে করেন এই রোগ ছোঁয়াচে। ধারণাটি কতটা ঠিক?

উত্তর: ঠিকই বলেছেন, অনেকের মধ্যে এমন ধারণা রয়েছে। কিন্তু সাধারণ ভাবে জ্বর বা সর্দির মতো এই রোগ ছড়ায় না। সংক্রমিত রোগীর পাশে বসলে, কথা বললে বা হাত ধরলে এই রোগ ছড়ায় না। এমনকি, সংক্রমিত রোগীর গালে চুম্বন করলে বা তাঁর ব্যবহৃত বাসন ব্যবহার করলেও এই রোগ অন্যের শরীরে ছড়ায় না। মশার মাধ্যমে এইচআইভি এক শরীর থেকে অন্য শরীরে যায় বলে যে ধারণা রয়েছে, সেটাও অমূলক।

প্রশ্ন: অনেক সময় এইচআইভি আক্রান্ত রোগীকে একঘরে করে রাখা হয়। সেটাও তো তা হলে উচিত নয়?

উত্তর: না, একবারেই নয়। বরং তাঁকে বোঝানো দরকার এটা একটা ক্রনিক রোগ। নানা ভাবে এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব। একঘরে করে রাখা মোটেও উচিত নয়।

প্রশ্ন: এইচআইআইভি সংক্রমণ মানেই কি এডস রোগ হয়েছে?

উত্তর: এই বিষয়ে একটু বিস্তারিত বলে রাখা ভাল। প্রথমেই জানিয়ে রাখি এইচআইভি সংক্রমণ তিনটি ধাপে হয়। প্রথম ধাপ, অ্যাকিউট স্টেজ বা অ্যাকিউট রেট্রোভাইরাল সিনড্রোম। যা সংক্রমণের ৩ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে হয় এবং নিজে থেকেই ২-৪ সপ্তাহের মধ্যে সেরে যায়। এতে সাধারণত, জ্বর বা সর্দি-কাশির মতো সমস্যা দেখা যায়। দ্বিতীয় ধাপ, ক্লিনিক্যাল ল্যাটেন্সি বা ক্রনিক স্টেজ। এই স্টেজে সাধারণত সংক্রমণের কোন লক্ষণ সে ভাবে শরীরে প্রকাশ পায় না। তৃতীয় এবং অন্তিম ধাপ হল এডস। এই পর্যায়ে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে পড়ে। সেই সময় শরীরে নানা সংক্রমণ ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। একই সঙ্গে প্রাণঘাতী নানা লক্ষণ প্রকাশ পায়।

প্রশ্ন: এডস মানেই প্রাণঘাতী, ধারণাটা সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে। এটা কি সত্যি, যে এডস মানেই মৃত্যু অবধারিত?

উত্তর: আগেই কোন ব্যাখ্যা না গিয়ে এটা পরিষ্কার করে দেওয়া উচিত যে, এডস মানেই মৃত্যু নয়। এইচআইভি দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধ্বংস করে। এই সুযোগে নানা সংক্রমণ মানব শরীরে বাসা বাঁধে। যা পরবর্তীকালে রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা এইচআইভি রোগের প্রাথমিক চিত্র। বর্তমানে কিন্তু এই রোগের উন্নততর চিকিৎসা পদ্ধতি অবিষ্কার হয়েছে। অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি-র (এআরটি) মাধ্যমে রোগীকে অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। যদি নিয়মমাফিক চিকিৎসা নেওয়া যায় এবং সতর্কতা গ্রহণ করা যায়, সে ক্ষেত্রে রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়।

প্রশ্ন: এই রোগের হাত থেকে বাঁচতে গেলে কী কী সতর্কতা নিতে হবে?

উত্তর: বেশ কিছু অতি সাধারণ বিষয়ে সতর্ক হলেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সেগুলি হল— শারীরিক মিলনের সময় কন্ডোম ব্যবহার, যৌন রোগের যথাযথ নির্ণয় ও চিকিৎসা। যে কোন যৌনরোগ হলেই আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। রক্ত দেওয়া বা নেওয়া অথবা ইনজেকশনের সময়ে একটি সিরিঞ্জ এক বারই ব্যবহার করুন। এই বিষয়গুলি খেয়াল রাখলে সহজেই এই রোগ থেকে বাঁচা সম্ভব।

প্রশ্ন: এই রোগের কি কি চিকিৎসা রয়েছে?

উত্তর: সংক্রমণ হলে আগেই ডাক্তারের কাছে যান। রোগ ধরা পড়লে বর্তমানে উন্নততর চিকিৎসা পদ্ধতি এআরটি-র মাধ্যমে রোগীকে দীর্ঘদিন বেশ অনেকটাই সুস্থ করা যাচ্ছে। এই চিকিৎসার ফলে, শরীরে এইচআইভি ভাইরাসের সংখ্যা কমে যায়। একই সঙ্গে সিডি-৪ বা টি-৪ সেলের সংখ্যাও বেড়ে যায়। ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও বেড়ে যায়।

প্রশ্ন: গর্ভবতী মায়ের এই রোগ হলে গর্ভস্থ শিশুকে কী বাঁচানো ও নীরোগ রাখা সম্ভব?

উত্তর: তিন ভাবে এই রোগ শিশুদেহে সংক্রমিত হতে পারে। গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালে ও স্তন্যপানের মাধ্যমে। তাই গর্ভের প্রথম অবস্থায়ই মায়ের এইচআইভি পরীক্ষা করানো উচিত। যদি দেখা যায়, মায়ের শরীরে এইচআইভি ইনফেকশন রয়েছে, তা হলে এআরটি চিকিৎসা শুরু করা উচিত। একই ভাবে স্তন্যপানের মাধ্যমে যে হেতু এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে তাই আক্রান্ত মায়ের শিশুকে স্তন্যপান করানো উচিত নয়। একই সঙ্গে প্রসবের পরেই চিকিৎসা শুরু করা আবশ্যিক।

প্রশ্ন: এই রোগের কোনও প্রতিষেধক আছে কি?

উত্তর: না, এই রোগের এখন কোনও প্রতিষেধক নেই। মানুষকে সচেতন হতে হবে। এটাই সব থেকে বড় প্রতিষেধক।

প্রশ্ন: এই জায়গাতেই আসছিলাম। সামনেই পয়লা ডিসেম্বর। বিশ্ব এডস দিবস। সচেতনতার লক্ষে নানা অনুষ্ঠান হবে। মানুষ কি সচেতন হচ্ছে?

উত্তরঃ অবশ্যই হচ্ছে। লাগাতার এই রোগ নিয়ে প্রচারের জেরে মানুষ আগের থেকে অনেক সচেতন হয়েছে। বলা যায় সেই কারণেই এই রোগ এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

প্রশ্ন: দুই বর্ধমানেই আপনি কাজ করেছেন, দুই বর্ধমানে রোগটির বর্তমান চিত্রটি কী?

উত্তর: দুই জেলায়ই কম-বেশি এই রোগে আক্রান্ত রোগী আমরা পেয়ে থাকি। অন্যান্য জায়গার মতো এই জেলার সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজগুলিতে বিনামূল্যে এইচআইভি পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য ‘ইন্টিগ্রেটেড কাউন্সিলিং অ্যান্ড টেস্টিং সেন্টার’ (আইসিটিসি)-র ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে রোগ ধরা পড়া বা চিকিৎসা নিয়ে জেলায় কোনও সমস্যা নেই।

প্রশ্ন: রোগ ধরা পড়লে কোথায় চিকিৎসা মেলে? খরচ কেমন হয়?

উত্তর: সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজগুলিতে বিনামূল্যে এইচআইভি পরীক্ষা-সহ চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালেও বহির্বিভাগে এই রোগের জন্য নির্দিষ্ট ঘর রয়েছে। সেখানে বিনামূল্যে পরিষেবা পাওয়া যায়।

সাক্ষাৎকার: সুপ্রকাশ চৌধুরী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement