অস্ত্রোপচার যাঁর দেহে, রক্ত দেওয়া হবেও তাঁর দেহ থেকে নিয়েই।
সাঁইত্রিশ বছর বয়সে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে কোমর প্রতিস্থাপন করাতে এসে কালনার বাসিন্দা অমিতা নায়েক (নাম পরিবর্তিত) জানতে পারলেন, প্রয়োজন পড়লে তাঁর গ্রুপেরই অন্য কারও রক্ত তিনি নিতে পারবেন না। অ্যান্টিজেনের কারিকুরিতেই এমন এক বিরল ধরন তৈরি হয়েছে তাঁর রক্তে, যা পশ্চিমবঙ্গে আদৌ আর কারও দেহে রয়েছে কি না চিকিৎসক-গবেষকদের জানা নেই। পরিচিত কোনও গ্রুপের রক্তই তাঁর দেহে দেওয়া যাবে না। অথচ তাঁর দ্রুত অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। অগত্যা অগতির গতি তাঁর নিজের রক্ত। আপাতত ওষুধ খাইয়ে তাঁর হিমোগ্লোবিন বাড়াচ্ছেন চিকিৎসকেরা। বাড়ার পর তাঁর দেহ থেকেই কয়েক ইউনিট রক্ত সংগ্রহ করে তার পর সেই রক্তের সাহায্যেই কোমর প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচার হবে অমিতাদেবীর। এই নিজের রক্ত নিজেকে দেওয়াকে চিকিৎসার ভাষায় বলা হয় ‘অটোলগাস ট্রান্সফিউশন।’
জীবনে আগে কখনও রক্তের প্রয়োজন হয়নি পেশায় সরকারি হাসপাতালের নার্স অমিতাদেবীর। ২০১৪ সাল থেকে তাঁর কোমরের সমস্যা বেড়ে যায়। চিকিৎসকেরা রায় দেন, কোমর প্রতিস্থাপন করাতে হবে। সেই মতো চলতি বছর জানুয়ারিতে তিনি চেন্নাইয়ে এক হাসপাতালে যান। পরীক্ষা করে দেখা যায়, তাঁর রক্তের গ্রুপ ‘বি পজিটিভ।’ অস্ত্রোপচারের আগে চিকিৎসকেরা তাঁকে এক ইউনিট রক্ত দেন। তাতেই শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অস্ত্রোপচার স্থগিত হয়ে যায়। কিন্তু রক্ত নিয়ে এই রকম হওয়ার রহস্য তখন আবিষ্কার করতে পারেননি চিকিৎসকেরা। এ দিকে, তিনি কোমরের সমস্যার জন্য প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়েছেন। প্রতিস্থাপন না করলেই নয়। ফলে বাড়ির লোক তাঁকে নিয়ে আসেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
মেডিক্যালের ‘ইমিউনো হেমাটোলজি অ্যান্ড ব্লাড ট্রান্সফিউশন মেডিসিন’-এর বিভাগীয় প্রধান কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বিস্তারিত পরীক্ষার পর দেখা যায়, আপাত ভাবে ওই মহিলার রক্ত ‘বি পজিটিভ’ হলেও বেশ কিছু সাধারণ অ্যান্টিজেন তাঁর রক্তে অনুপস্থিত। ফলে বি-পজিটিভ বা অন্য কোনও গ্রুপের রক্ত তাঁর দেহে দেওয়া যাবে না। দিলেই প্রতিক্রিয়া হবে।
মেডিক্যালের ইমিউনো হেমাটোলজিস্ট দেবপ্রিয়া বসুকুমার ব্যাখা দেন, মানুষের রক্তে যে ‘আরএইচ’ টাইপ থাকে তাতে পাঁচ ধরনের অ্যান্টিজেন থাকে। ডি (D), বড় হাতের সি (C), ছোট হাতের সি (c), বড় হাতের ই (E) এবং ছোট হাতের ই (e)। এর মধ্যে ডি অ্যান্টিজেন রক্তে থাকলে সেই রক্তের গ্রুপ ‘পজিটিভ’ হয় এবং ডি না থাকলে গ্রুপ ‘নেগেটিভ’ হয়। বাকি চারটে অ্যান্টিজেনের কোনও না কোনও ‘কম্বিনেশন’ সাধারণত ৯৯.৯% মানুষের থাকে। অমিতাদেবীর ক্ষেত্রে রক্তের গ্রুপ বি। কিন্তু তাঁর ‘আরএইচ’ টাইপে ‘ডি’ অ্যান্টিজেন থাকলেও বাকি চারটি অ্যান্টিজেনের (C,c,E,e) কোনওটিই নেই। ফলে তাঁর রক্ত আপাত ভাবে বি পজিটিভ হলেও অন্য কারও বি পজিটিভ বা অন্য কোনও গ্রুপ তাঁর সঙ্গে মিলছে না। দিলেই শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে এবং প্রতিক্রিয়া হচ্ছে।
হেমাটোলজিস্ট প্রশান্ত চৌধুরী জানান ওই চারটি ‘কমন অ্যান্টিজেন’ রক্তে না থাকাটা খুবই বিরল। রাজ্যে বা দেশে আদৌ এই রকম আর কেউ আছে কি না তার কোনও পরিসংখ্যান নেই। তিনি আরও জানান, এক বার এক মহিলা রোগী পেয়েছিলেন, যাঁর রক্তে E বা e এর মধ্যে কোনও অ্যান্টিজেন ছিল না। ফলে তাঁর বার বার গর্ভপাত হয়ে যাচ্ছিল। কারণ যে ভ্রূণগুলি তৈরি হচ্ছিল তাদের দেহে ওই অ্যান্টিজেন ছিল, ফলে মায়ের রক্তের সঙ্গে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ওই মহিলা শিশু দত্তক নিয়েছিলেন।
চিকিৎসক ও গবেষকদের মতে, এই সব ক্ষেত্রে কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ করে রাখা উপযোগী হতে পারে। কারণ ল্যাবরেটরিতে এখন কর্ড ব্লাড স্টেম সেল থেকে রক্ত তৈরি করা যাচ্ছে। আর বছর দু’য়েকের মধ্যে সেই রক্ত বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহারও করা যাবে। ফলে অমিতাদেবীর মতো মানুষদের কর্ড ব্লাড রাখা থাকলে প্রয়োজনে সেখান থেকে তৈরি রক্ত তাঁদের দেহে দেওয়া যেতে পারবে।