অতিমারি কোভিড যেমন এখন আমাদের কাছে অপরিচিত নয়, তেমনই অপরিচিত নয় কোভিডের হাত ধরে আসা একের পর এক রোগ। এর মধ্যে অন্যতম হল পালমোনারি ফাইব্রোসিস। কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পরবর্তী সমস্যা হিসেবে এটি এখন বেশ পরিচিত। কিন্তু জীবনযাপনে ঠিক কতটা ক্ষতি করতে পারে এই অসুখটি তা সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। ফাইব্রোসিস যে শুধু ফুসফুসের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা নষ্ট করে তা নয়, ফুসফুসের স্থায়ী ক্ষতিও করে। কোভিডের পরে অনেকে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক, ধূমপায়ীরা, এখন ধূমপান ত্যাগ করলেও আগে ধূমপানের অভ্যেস থাকলে তাঁরাও বিভিন্ন কারণে পালমোনারি ফাইব্রোসিসে আক্রান্ত হতে পারেন।
কাকে বলে পালমোনারি ফাইব্রোসিস?
ফুসফুসের যে অসুখে ফুসফুসের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও ধীরে ধীরে স্থূল ও শক্ত হয়ে গিয়ে শ্বাসকার্যে বাধার সৃষ্টি করে তাকেই বলে পালমোনারি ফাইব্রোসিস। শক্ত হয়ে যাওয়া কোষসমূহের ফলে ফুসফুস স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে পারে না। তখনই শুরু হয় শ্বাস নেওয়ার সমস্যা। পালমোনোলজিস্ট ডা. অনির্বাণ নিয়োগী বললেন, ‘‘ফুসফুসের সমস্ত সংক্রমণই ঠিক ভাবে চিকিৎসা না হলে শেষ পর্যন্ত ফাইব্রোসিসে পরিণত হয়। আমাদের ত্বকে কেটে গেলে যেমন স্কার হয়, তেমনই শরীরের ভিতরের প্রত্যঙ্গগুলিতে, বিশেষ করে ফুসফুসে সংক্রমণ হলে সেই অংশগুলি নষ্ট হয়ে গিয়ে স্কার টিসু তৈরি হয়।’’
এই স্কার টিসুগুলি বাতাস ও ফুসফুসের অ্যালভিওলাইয়ের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। ফলে, রক্তপ্রবাহে অক্সিজেন প্রবেশ করা ক্রমশ দুরূহ হয়ে পড়ে। কার্বন ডাই অক্সাইডও বেরোতে পারে না। ফলে তৈরি হয় সমস্যা।
ফাইব্রোসিস কত প্রকার?
পালমোনারি ফাইব্রোসিস একটিই অসুখ এটা মনে করলে কিন্তু ভুল করা হবে। ডা. নিয়োগী জানালেন, কমপক্ষে ২০০ রকমের ফুসফুসের অসুখকে ফাইব্রোসিসের আওতায় আনা যায়। আবার, সম্পূর্ণ ফাইব্রোসিসের বিষয়টি পড়ে ইন্টারস্টিশিয়াল লাং ডিজ়িজ়ের (আইএলডি) আওতায়। ফুসফুসের দেওয়ালে কোনও রকম সংক্রমণ হলেই তাকে আইএলডি বলা চলে। তবে, যে আইএলডিতে ফুসফুসে স্কার টিসু তৈরি হয় সেটিই ফাইব্রোসিস নামে পরিচিত হয়।
কী কী থেকে হতে পারেএই অসুখ?
সাধারণত, এই অসুখের কারণকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়—
* ইডিয়োপাথিক: বেশির ভাগ সময় কোনও কারণ ছাড়াই ফাইব্রোসিস হতে পারে। একে আর এক ভাবে বলা চলে ক্রিপ্টোজেনিক ফাইব্রোজ়িং অ্যালভিওলাইটিস। অনেক ক্ষেত্রে জিনগত কারণ বা বংশগতির ধারা হিসেবে ফাইব্রোসিস হতে পারে। ইডিয়োপাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিস বা আইপিএফ প্রাণঘাতীও হতে পারে। ঠিক সময়ে চিকিৎসা না শুরু করলে এক সময়ে বিছানাবন্দি হয়ে যাওয়ার ভয়ও থাকে। দিতে হয় অক্সিজেন। ডা. নিয়োগীর কথায়, ‘‘কখনও ১৫ ঘণ্টা অক্সিজেনও দিতে হতে পারে, যাকে বলে লংটার্ম অক্সিজেন থেরাপি। ধরে নেওয়া হয়, কেউ এতে আক্রান্ত হলে সাত থেকে দশ বছর তাঁর আয়ু রয়েছে।’’
* অটোইমিউন: অটোইমিউন ডিজ়িজ়ের কারণে ফুসফুসে ফাইব্রোসিস হতে পারে। হাত ও মুখের চামড়ার পরিবর্তন, শরীরে গাঁট ফুলে যাওয়া দেখে অনেক সময়ে চিকিৎসকেরা শনাক্ত করতে পারেন।
* রেডিয়েশন বা অন্য অসুখের জন্য: টিবি, কোভিড, নিউমোনিয়া, ক্যানসার ও অন্যান্য অসুখের ফলে, কোনও বিশেষ ওষুধ ব্যবহারে ও ক্যানসারের চিকিৎসায় রেডিয়েশন থেরাপির ফলে হতে পারে।
* পরিবেশগত ও পেশাগত: পরিবেশের ধুলো, মোল্ড, প্রাণিজ কিছু থেকে ও পেশাগত ভাবে সিলিকা, অ্যাসবেস্টস ও কয়লা নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের হতে পারে সংক্রমণ।
উপসর্গ কী এই অসুখের?
ফাইব্রোসিসে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ ব্যক্তিবিশেষে আলাদা হতে পারে। তবে, সূচনা হয় শুকনো কাশি দিয়েই। ডা. নিয়োগী বললেন, ‘‘চল্লিশোর্ধ্ব কারও যদি এক মাসেরও বেশি শুকনো কাশি চলে ও শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে, তা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এ ছাড়া যে উপসর্গগুলি অবশ্যম্ভাবী তা হল,
* ওজন হ্রাস
* ক্লান্তি
* শ্বাসকষ্ট
* পেশিতে টান ও পেশির ক্লান্তি গাঁটে গাঁটে ব্যথা
অসুখ যত বাড়তে থাকে তত হাত ও পায়ের আঙুল মাত্রাতিরিক্ত গোলাকার হয়ে উঠতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে দেখা যায় সাইনোসিস, অর্থাৎ রক্তে অক্সিজেনের অভাবে ঠোঁট ও চোখের চারপাশের ত্বক নীলচে বা ছাই বর্ণের হয়ে ওঠে।
চিকিৎসা কী?
ডা. নিয়োগী জানালেন, পালমোনারি ফাইব্রোসিসের সে ভাবে চিকিৎসা এখনও নেই। অদ্ভুত ভাবে এটাকে প্রতিরোধ করাও কঠিন। কিছু ওষুধ ব্যবহার করা চলে, তবে সেগুলিও আংশিক ভাবে কাজ করে। চিকিৎসকদের খুব খেয়াল রেখে চিকিৎসা করতে হবে। ফুসফুসে কোনও রকম সংক্রমণ হলে সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। পালমোনারি এমবলিজ়ম হলে ব্লাড থিনার দিতে হবে।
আসল কথা হল, কোনও ভাবে ফুসফুসকে আহত বা সংক্রমিত থাকতে দেওয়া চলবে না।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।