Breastfeeding

সন্তানের ক্ষুরধার বুদ্ধি ও সুস্থতার বীজ লুকিয়ে আছে কীসে জানেন?

সন্তানের মস্তিষ্কের সার্বিক বিকাশ ও সুস্থ শরীর চান? তা হলে অবশ্যই মেনে চলুন এই উপায়।

Advertisement

সুমা বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৮ ১৬:১৯
Share:

মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালনে পিছিয়ে নেই ভারতও। ছবি: পিক্সঅ্যাবে।

সন্তানকে যে মায়ের দুধ দিতে হয়, তা অন্য সব স্তন্যপায়ী প্রাণী জানলেও সৌরজগতের সব চেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীদেরই বারবার মনে করিয়ে দিতে হয়! ‘ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর ব্রেস্ট ফিডিং অ্যাকশন’ এই মনে করানোর কাজটা করে চলেছে দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে। ১৯৯০ সালে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ ও ‘ইউনিসেফ’ যৌথ ভাবে মাতৃদুগ্ধের উপকারিতা সম্পর্কে প্রচার শুরু করে।

Advertisement

এই তিন সংস্থার উদ্যোগে ১৯৯২ সালের ১–৭ অগস্ট প্রথম ‘মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ’ পালন শুরু হয় বিশ্ব জুড়ে। এ বছরেও সদ্য হওয়া মা ও তাঁদের পরিবারকে সচেতন করতে পৃথিবী জুড়ে পালন করা হচ্ছে এই সপ্তাহ। এ বছর ২৬ তম বর্ষে পা দিল এই উদ্যোগ। বিশ্বের ১২০ টি দেশের সঙ্গে ভারতও এতে অংশ নিচ্ছে।

আরও পড়ুন: মায়ের দুধ পায় না এশিয়ার বহু শিশু, চিন্তায় চিকিৎসক

Advertisement

বিশেষজ্ঞদের মতে, মায়ের দুধকে সদ্যোজাতর প্রথম ভ্যাকসিন বলা যায় অনায়াসে। বিশেষ করে, শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার কিছু ক্ষণ পর মায়ের বুকে যে হালকা হলদেটে দুধ নিঃসৃত হয়, তাতে আছে নানা ধরনের অ্যান্টিবডি। যা সদ্যোজাতকে রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। একে বলে কোলোস্ট্রাম। এ ছাড়া এই দুধ প্রোটিনে ভরপুর। এ প্রসঙ্গেই কথা বলছিলেন সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ মৌপিয়া চক্রবর্তী। মায়ের দুধের সঙ্গে কৃত্রিম বাজারজাত দুধ (ফর্মুলা মিল্ক)-এর একটা মূল পার্থক্য আছে। মায়ের দুধের উপাদান শিশুর প্রয়োজন অনুযায়ী অনবরত বদলে যায়। সদ্য জন্মানো শিশুর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত মাতৃদুগ্ধের উপাদান বদলাতে থাকে। ফর্মুলা দুধে কিন্তু তা হয় না।

তাই জন্মের পর থেকে প্রথম ছয় মাস শুধুমাত্র মায়ের দুধ দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। মৌপিয়া আরও জানান, মাতৃদুগ্ধে ডোকোসাহেক্সানোয়িক অ্যাসিড নামে একটি বিশেষ ধরনের উপাদান থাকে, যা শিশুর বুদ্ধির বিকাশে অত্যন্ত উপযোগী। বিভিন্ন ভাবনা-চিন্তা ও বুদ্ধি প্রয়োগে মস্তিষ্কের বিভিন্ন নতুন নতুন সংযোগ রক্ষাকারী পথ বিকাশের জন্যও তা প্রয়োজন।

ডোকোসাহেক্সানোয়িক অ্যাসিড (ডিএইচএ)। চিকিৎসা পরিভাষায় এর নাম নিউরোজেনেসিস। দৃষ্টিশক্তির বিকাশের জন্যও এই ডিএইচএ-র ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। কেননা, রেটিনার গঠন ও কাজকর্ম স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজন এই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। মায়ের দুধ পান করে বেড়ে উঠলে বুদ্ধি থেকে দৃষ্টিশক্তি— সবই ভাল থাকবে।

জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে স্তন্যপান করান, পরামর্শ চিকিৎসকদের। ছবি: পিক্সঅ্যাবে।

পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের মৃত্যুর বিষয়ে আমাদের দেশ একেবারে প্রথম সারিতে। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’-র হিসাব অনুযায়ী, আমাদের দেশে প্রত্যেক বছর পাঁচ বছরের কমবয়সী অজস্র শিশু মারা যায় স্রেফ ডায়েরিয়ার কারণে। পাকিস্থান, মায়ানমার, কেনিয়াকে পিছনে ফেলে শিশুমৃত্যুর ব্যাপারে অনেক কদম এগিয়ে ভারত। এই ঘটনা প্রতিরোধ করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারেন মায়েরা। হ্যাঁ, বিশেষজ্ঞরা অন্তত তাই বলছেন। জন্মের পর থেকে প্রথম ছয় মাস যে শিশু শুধুমাত্র মায়ের দুধ খেয়ে বেড়ে ওঠে, তার ডায়েরিয়া-সহ অন্যান্য অসুখবিসুখের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়।

আরও পড়ুন: শরীরে কি বাসা বাঁধছে ডায়াবিটিস? নিজে নিজেই বুঝে যান এই ভাবে

কথা হচ্ছিল ল্যাকটেশন নার্স সায়ন্তী নাগচৌধুরীর সঙ্গে। সল্টলেকের একটি বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত সায়ন্তী জানালেন, বাইরের বিভিন্ন উন্নত দেশে হবু মায়েদের স্তনদুগ্ধ পান সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সম্প্রতি আমাদের দেশেও সেই ভাবনার সূত্রপাত হয়েছে।

প্রত্যেক বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মায়ের দুধের উপযোগিতা ও সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ খাওয়াতে উৎসাহ দিয়ে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ বছর ২৬ তম ‘মাতৃদুগ্ধ পান সপ্তাহ’-এ এই ব্যাপারে অনেক বেশি উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। হবু মা প্রসবের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হলেই সায়ন্তী তাঁদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। মায়ের দুধই যে শিশুর সেরা খাবার তা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে দুধ দিলে চেহারা নষ্ট হওয়ার মত ভ্রান্ত ধারণা সম্পর্কেও সচেতন করেন। বরং স্তন্যপান করালে জরায়ু দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।

ইদানীং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুর জন্ম হয় বলে মা ব্যথায় কাতর থাকেন। শিশুকে স্তন্যপান করানোর কষ্ট সহ্য করতে চান না। এই ব্যাপারেও তাঁদের অনবরত কাউন্সেলিং করতে হয় বলে জানালেন সায়ন্তী। ইদানীং মায়েদের মধ্যে এই ব্যাপারে অনেক সচেতনতা বেড়েছে বলেও তিনি জানান। সায়ন্তী নিজে একটি বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত হলেও, অন্য হাসপাতালে শিশুর জন্ম দিয়েছেন এমন অনেক মা ওঁর কাছে স্তন্যদানের বিষয়ে পরামর্শ নিতে আসেন। বিশেষ করে, কর্মরতা মায়েরা মাতৃদুগ্ধ সংরক্ষণ করার বিষয়েও পরামর্শ নিতে চান, বলছিলেন সায়ন্তী। মায়ের দুধ খেলে শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মা-শিশু দু’জনের মধ্যেই একটা বন্ধন তৈরি হয়। এই ব্যাপারটাও মাথায় রাখা উচিৎ।

আরও পড়ুন: পলিসিস্টিক ওভারি নিয়ে ভয়? জেনে রাখুন দরকারি তথ্য

যে শিশু শুধুমাত্র মায়ের দুধ খেয়ে বেড়ে ওঠে, তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। ছবি: পিক্সঅ্যাবে।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ মৌপিয়া চক্রবর্তী জানান, সদ্যোজাত শিশুর পাচনতন্ত্র বা ডাইজেস্টিভ সিস্টেম ওদের মতোই ছোট্ট আর অপরিণত। অন্য খাবার খাওয়া আর হজম করা বেশ মুশকিলের। আর ঠিক এই কারণেই ওদের জন্য আদর্শ খাদ্য হল কোলোস্ট্রাম। প্রোটিন, ভিটামিন-এ ও সোডিয়াম ক্লোরাইড সমৃদ্ধ অত্যন্ত পুষ্টিগুনসম্পন্ন এই দুধ সামান্য খেলেই শিশুর পেট ভরে যায়।

অন্য দিকে সদ্য মায়ের এই হলদেটে দুধে গ্রোথ ফ্যাক্টর ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ফ্যাক্টর থাকায় শিশুর ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রথম ধাপ তৈরি হয়। আর পুষ্টির দিক থেকে মায়ের দুধের কোনও বিকল্প নেই। এ দিকে সদ্যোজাত শিশুরাও চায় সহজে পেট ভরাতে। বোতল টানলে অল্প পরিশ্রমেই বেশি দুধ পায়, তাই এক বার বোতলে অভ্যস্ত হলে কষ্ট করে আর মায়ের দুধ টেনে খেতে চায় না। তাই চিকিৎসকদের পরামর্শ, জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে স্তন্যপান করান।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement