প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
অনেক সময়েই দেখা যায়, ছোট বাচ্চার বাড়বৃদ্ধি যেন এক জায়গায় আটকে আছে। সে ক্রমাগত ঘ্যানঘ্যান করছে, নাভির অংশটা ফুলে আছে, মানসিক বিকাশেও যেন জড়তা রয়েছে। মা-বাবা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে, তিনি হয়তো বললেন ওর থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা রয়েছে। তখন মা-বাবা ভয় পেয়ে যান। তবে, বাচ্চাদের থাইরয়েডের সমস্যা হলে তা একেবারে নির্মূল করে তাকে পুরোপুরি সুস্থ জীবন ও ভবিষ্যৎ উপহার দেওয়া সম্ভব। ছোটদের থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা, রোগলক্ষণ ও চিকিৎসা নিয়ে বিশদে বুঝিয়ে দিলেন ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের শিশুরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. দিব্যেন্দু রায়চৌধুরী।
সমস্যার মূলে হাইপোথাইরয়েডিজ়ম
ডা. রায়চৌধুরী জানাচ্ছেন, থাইরয়েডের সমস্যা দুই রকমের হয়। হাইপোথাইরয়েডিজ়ম বা থাইরয়েড হরমোন কম ক্ষরণজনিত সমস্যা এবং হাইপারথাইরয়েডিজ়ম অর্থাৎ এই হরমোন বেশি ক্ষরণের সমস্যা। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি হাইপোথাইরয়েডিজ়মই বেশি দেখা যায়। প্রাইমারি হাইপোথাইরয়েডিজ়মের কারণগুলি মোটামুটি এই রকম:
· কোনও ‘অটোইমিউন’ (যেখানে অনাক্রম্যতা শক্তি শরীরকেই আক্রমণ করে) কারণে হতে পারে।
· বাচ্চার থাইরয়েড গ্রন্থি ভাল করে তৈরি না হলে স্বাভাবিক ভাবেই থাইরয়েডের ক্ষরণ কম হয়।
· থাইরয়েডের সংক্রমণ বা কোনও অসুখের কারণে শল্যচিকিৎসা করে বাচ্চার থাইরয়েড গ্রন্থির খানিকটা বাদ দিলেও হাইপোথাইরয়েডিজ়ম হয়।
· গর্ভাবস্থায় মা কিছু বিশেষ ধরনের ওষুধ খেলেও বাচ্চার হাইপোথাইরয়েডিজ়ম হয়।
· বাচ্চা ‘লিথিয়াম’, ‘অ্যামিয়োডারোন’ জাতীয় ওষুধ খেলেও তার এই সমস্যা হতে পারে।
এ ছাড়া কোনও কারণে রেডিয়েশন দেওয়ার কারণে বা জোরে আঘাত লাগলেও সেকেন্ডারি হাইপোথাইরয়েডিজ়ম হতে পারে। দেহের ‘হরমোন রিসেপ্টর সিস্টেম’ ঠিক ভাবে কাজ না করলেও বাচ্চার শরীর থাইরয়েড হরমোনের কার্যকারিতার সুফল গ্রহণ করতে পারে না।
হাইপোথাইরয়েডিজ়মের রোগলক্ষণ কী কী
· বাচ্চার সার্বিক বিকাশে খামতি থাকে। একে বলে ক্রেটিনিজ়ম।
· বাচ্চার জিহ্বা বড় হতে পারে, মুখটা ফোলা ফোলা লাগে।
· পেশিতে শৈথিল্য থাকে। পেটটা ফোলা লাগে। থাইরয়েডের কারণেও খুব ছোট বাচ্চার আম্বিলিক্যাল হার্নিয়া (নাড়ি ফুলে থাকা)হতে দেখা যায়। হাড়ের গঠনে সমস্যা হতে পারে।
· ত্বক খসখসে হয়।
· কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা যায়।
· অল্পতেই বাচ্চার শীত করবে।
· কনজেনিটাল হাইপোথাইরয়েডিজ়মের ক্ষেত্রে (যেখানে জন্ম থেকেই থাইরয়েড গ্রন্থি ঠিক মতো কাজ না করার ফলে থাইরয়েড ক্ষরণ কম থাকে) মস্তিষ্কের বিকাশে প্রভাব পড়তে পারে। মানসিক গঠন ঠিক মতো হয় না, আই কিউ লেভেল কমের দিকে থাকতে পারে। এর ফলে বাড়বৃদ্ধি সময় মতো হয় না। ব্রহ্মতালু সময়মতো বন্ধ হয় না (অর্থাৎ জন্মের পর যেমন ছিল, স্ক্যাল্পের একটি গোলাকার অংশ সে রকমই দপদপ করতে থাকে)।
প্রতিকারের উপায়
ডা. রায়চৌধুরীর আশ্বাস, খুব সহজেই কনজেনিটাল হাইপোথারয়েডিজ়ম রুখে দেওয়া সম্ভব। শিশুর জন্মের পর থাইরয়েড স্ক্রিনিং করা হয়। তাতে সেরাম টি-ফোর আর টিএসএইচ-এর মাত্রা দেখে নেওয়া হয়। সেরাম টি-ফোর কম বা টিএসএইচ বেশি থাকলেই বোঝা যায় যে, বাচ্চার হাইপোথাইরয়েডিজ়ম হচ্ছে। তখনই হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি শুরু করে দেওয়া হয়। এর ফলে বাচ্চা একেবারে সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে যায়। তার কোনও মানসিক সমস্যা থাকে না। আর পাঁচটা বাচ্চার সঙ্গে শারীরিক বা মানসিক কোনও প্রভেদও থাকে না। কিন্তু এই সময়ে যদি রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু করা না হয়, তবে বাচ্চার মস্তিষ্ক স্থায়ী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাকে কিন্তু আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না।
জন্মের কয়েক মাস বা কয়েক বছর পরেও যদি হঠাৎ থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা হয় তবে লক্ষণ দেখে হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপিতে ওষুধের ডোজ় নির্ধারণ করা হয়। ছোট বাচ্চার ক্ষেত্রে প্রতি কেজি ওজনের জন্য ডোজ় বেশি, বড়দের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি ওজনে ডোজ় কম।
স্কুলপড়ুয়া সন্তানের দিকেও লক্ষ রাখুন
জন্মের সময়ে থাইরয়েডের সমস্যা না থাকলেও পরে ওষুধ খাওয়া, সার্জারি বা কোনও কারণে এই অসুখ হতে পারে। একে ‘অ্যাকোয়ারড হাইপোথাইরয়েডিজ়ম’ বলা হয়। অনেক সময়ই দেখা যায় বয়ঃসন্ধির কোনও স্কুলপড়ুয়ার শারীরিক গঠন সমবয়সিদের থেকে একটু আলাদা। হয়তো, তার চোখমুখ ফোলা, চেহারাটা ভারী এবং গলার কাছে ফোলা ভাব আছে। এর জন্য বন্ধুদের সামনে সে গুটিয়ে থাকতে পারে। অভিভাবক বা স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা এমন ছেলেমেয়ের দিকে একটু বিশেষ নজর দিন। হতে পারে, তারও থাইরয়েডের সমস্যা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। ডা. রায়চৌধুরী জানাচ্ছেন, একটু বড় বয়সে কিন্তু রোগলক্ষণগুলি সূক্ষ্ম হয়। তিনি স্কুলপড়ুয়ার শরীরে থাইরয়েডের সমস্যার লক্ষণগুলি চিনিয়ে দিলেন। বললেন, মেয়েদের ক্ষেত্রে ওজন বেশির দিকে হয়, ঋতুচক্র অনিয়মিত থাকে, শীত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগে। এদের গয়টারও হয়। অর্থাৎ, গলার সামনের দিকটা ফুলে যায়। এ ক্ষেত্রে থাইরয়েড কম সংশ্লেষ হলে গ্ল্যান্ডটা নিজেকে আরও বড় করে আরও হরমোন সংশ্লেষের চেষ্টা করে। এ সব ক্ষেত্রেও চিকিৎসার মাধ্যমে সমস্যা উধাও হবে। পরিপূর্ণ সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন লাভ করা সম্ভব হবে।