Mental and Physical health

সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, নজর দিতে হবে দু’দিকেই

আত্মহত্যার কারণ কি নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব? লক্ষণ চেনার উপায়ই বা কী? রইল বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

Advertisement

দীপান্বিতা মুখোপাধ্যায় ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৫ ১০:৩১
Share:

Sourced by the ABP

কোথাও পরিবারের সকলে মিলে আত্মহত্যা, কোথাও মা তাঁর সন্তানকে নিয়ে ঝাঁপ দিচ্ছেন, কোথাও বা এক ঝকঝকে তরুণ শেষ করে দিচ্ছেন নিজের জীবন। সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদমাধ্যমে এমন নানা আত্মহত্যার ঘটনা উঠে এসেছে। কিছু ক্ষেত্রে কারণ জানা গিয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে তা স্পষ্ট নয়। আর্থিক সমস্যা, কাজের চাপ, গার্হস্থ্য হিংসা... নানাবিধ সামাজিক কারণের পাশাপাশি মানসিক সমস্যাও আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে আসে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আবীর মুখোপাধ্যায় বললেন, “আমাদের দেশে প্রায় ৫০ শতাংশ আত্মহত্যার ঘটনা কিন্তু মানসিক অবসাদ সংক্রান্ত নয়, অনেকটাই সামজিক। চাষিদের আত্মহত্যার কথা ধরা যাক, সেখানে কারণটা আর্থিক। কোভিডের পর আর্থিক কারণে আত্মহত্যা করার বেশ কিছু ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছিল।”

Advertisement

আভাস পাওয়া যায়?

অনেক সময়েই দেখা যায় সচ্ছল জীবনযাত্রা, আপাতদৃষ্টিতে সুখী পরিবার। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনও যুবক আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন। এমনটা কেন ঘটে? মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রামের কথায়, “আপাতদৃষ্টিতে কথাটা এখানে খুব জরুরি। কার মনের ভিতরে কী চলছে, তা অত্যন্ত কাছের মানুষের পক্ষেও বহু সময়ে বোঝা সম্ভব হয় না। অনেক সময়েই আত্মহত্যার নির্দিষ্ট কারণ বলা যায় না। এটা কমপ্লেক্স ইভেন্ট। যে ঘটনায় আমি হয়তো আত্মহত্যার কথা ভাববই না, সেই ঘটনা কিন্তু অন্য কারও কাছে জীবনের চরমতম অবস্থা হতে পারে।” চিহ্নিত না হওয়া মানসিক রোগ, কাজের স্ট্রেস, হীনম্মন্যতা... নানাবিধ সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করলেন তিনি। সবচেয়ে বেশি জোর দিলেন ‘আশাহীনতা’র উপরে। “কারও মনে হচ্ছে সমস্যাটা থেকে তিনি কিছুতেই বেরোতে পারবেন না এবং কারও সঙ্গে তা শেয়ারও করতে পারছেন না— এমন পরিস্থিতিতে কিন্তু মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেন,” বললেন ডা. রাম। এ ছাড়া রয়েছে চান্স ইভেন্ট। অর্থাৎ মোবাইল দেওয়া হল না, পরীক্ষার রেজ়াল্ট ভাল হয়নি বা ব্যবসায় ভরাডুবি হয়েছে... আচমকা কিছু ঘটনা।

Advertisement

বেশ কিছু তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরলেন ডা. আবীর মুখোপাধ্যায়—

  • আমাদের দেশে ১৫-২৯ বা ৩৯ বছর বয়সি মহিলাদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ আত্মহত্যা। অর্থাৎ সারা দেশে যদি এই বয়সসীমার ১০০ জন মহিলা মারা যায়, দেখা যাবে অধিকাংশেরই মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা। বাকিরা হয়তো অসুস্থতা বা দুর্ঘটনাজনিত কারণে মারা গিয়েছে।
  • আমাদের দেশে বৈবাহিক কারণে মহিলাদের মধ্যে আত্মহত্যার হার ৮ শতাংশ। একই কারণে পুরুষদের মধ্যে তা ০.৮ শতাংশ। এর কারণ হিসেবে উঠে আসে মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দেওয়া, গার্হস্থ্য হিংসা, আর্থিক পরাধীনতা ইত্যাদি।
  • নাবালিকা মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা গত ছ’-সাত বছরে বেড়েছে।

কেউ আত্মহননের পথ বেছে নেবেন কি না, সেটা বুঝতে পারাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সুইসাইড অনুমান করা গেলে তার হারও কমানো যেত। তবে কিছু ক্ষেত্রে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ডা. মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, “কিছু ব্যক্তি ইমপালসিভ আচরণ করে। কমবয়সি একজন হঠাৎ করে উইল বানিয়ে ফেলল, কাছের কাউকে টাকাপয়সার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছে, ধার-দেনা মিটিয়ে ফেলছে... এগুলো একটা আভাস দেয়।” বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজ়অর্ডার, নেশাসক্তি (অ্যালকোহল, ড্রাগ) আছে... এ ধরনের মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনায় আরও একটি দিক উঠে আসে। নন সুইসাইডাল সেল্ফ ইনজুরি। এঁরা নিজেদের আঘাত করেন। হাত কেটে ফেলা, ঘুমের ওষুধের ওভারডোজ়... এঁরা কিন্তু মৃত্যুকামনা করে এগুলো করেন না। একটা সাময়িক রিলিফ পান বা এর মাধ্যমে সাহায্য চাওয়ার চেষ্টা করেন। “এই সমস্যাটাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। ‘ও তো প্রায়ই হাত কাটে, এত পাত্তা দিতে হবে না’ এটা ভাবলে চলবে না। দুর্ঘটনাবশতও খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে। দেখা গিয়েছে গুরুত্ব না দেওয়ায় কেউ হয়তো সত্যি করেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন,” বললেন ডা. মুখোপাধ্যায়।

সচেতনতা বনাম বদ্ধ ধারণা

মানসিক রোগ নিয়ে মানুষের মধ্যে আগের চেয়ে সচেতনতা বেড়েছে। নিজের ডিপ্রেশন বুঝতে পেরে অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। তা সত্ত্বেও কোথাও খামতি রয়ে গিয়েছে। অনেক শিক্ষিত, সচেতন ব্যক্তি নিজের মানসিক অবসাদের কথা বুঝতে পেরেও চিকিৎসকের কাছে যান না। ডা. আবীর মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “সচেতনতা আর স্টিগমা আলাদা জিনিস। অনেকেই মানতে পারেন না তিনি মানসিক ভাবে অসুস্থ। অনেকে আবার নিজের মানসিক অসুস্থতার কথা প্রকাশ্যে আনতে চান না। আইটি বা বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত অনেক পেশেন্ট অনুরোধ করেন, প্রেসক্রিপশনে মানসিক স্বাস্থ্যের কথা না লিখতে। কারণ অফিসে তাঁকে নিয়ে আলোচনা হবে, আড়ালে মন্তব্য করবে, দুর্বল মনে করবে... এই ভাবনাগুলো তাঁর মধ্যে কাজ করে।”

অন্যের উপরে প্রভাব

কারও আত্মহত্যার ঘটনায় অন্য কেউ প্রভাবিত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারে। এটাকে বলা হয় কপিক্যাট সুইসাইড। অভিনেতা সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুর ঘটনা অনেককে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর মতো ব্যক্তিত্ব যদি সমস্যার মোকাবিলা না করতে পেরে আত্মহত্যা করেন, তা হলে সাধারণ মানুষ আরও অসহায়। অন্য দিকে, কোনও পরিবারে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটলে, সেই ক্ষত বাকিদের সারা জীবন বইতে হয়। কাছের মানুষেরা অপরাধবোধে ভোগেন, তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কাটাছেঁড়া চলে।

আটকানোর উপায়

মনোবিদদের মতে, আত্মহত্যার পথগুলো বন্ধ করার দিকে নজর দিতে হবে। চিকিৎসক জয়রঞ্জন রামের পরামর্শ, “যে সব জায়গায় আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে, সেই জায়গাগুলো সুরক্ষিত করতে হবে। মেট্রো রেলে গার্ডরেল বসানো, ব্রিজে গার্ড দেওয়া, প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘুমের ওষুধ না দেওয়া ইত্যাদি। আইআইটি-তে এখন পাখাগুলো এমন ভাবে লাগানো হয়, যাতে দড়ি বাঁধতে গেলে পাখাটাই ভেঙে পড়ে। দেখা গিয়েছে সাইকোলজিক্যাল ইন্টারভেনশনের চেয়ে আত্মহত্যা আটকানোর জন্য এই উপায়গুলো বেশি কার্যকর।”

আরও একটি দিকে নজর দিতে হবে। আত্মহত্যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই সংক্রান্ত আইনি নিয়ম নিয়ে পর্যালোচনা চলছে এখনও। কেউ আত্মহত্যার
চেষ্টা করার পর পুলিশি তদন্তের চাপে তার মানসিক অবসাদ আরও বেড়ে যায়। এই কারণে অনেকে আত্মহত্যার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। এতে মূল সমস্যায় নজর দেওয়া হয় না। তবে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া অবশ্যই দণ্ডনীয় অপরাধ।

ডা. মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, “পাবলিক হেলথ প্রবলেম ভেবে এ ক্ষেত্রে পদক্ষেপ করা দরকার। প্রয়োজন সামাজিক পরিস্থিতির সার্বিক উন্নয়ন। অফিসে কাজের পরিবেশ ভাল করা, স্কুলে পড়াশোনার চাপ কমানো ইত্যাদির দিকে নজর দিতে হবে।” ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন অবজ্ঞা করার বিষয় নয়। পরিচিত কেউ অবসাদগ্রস্ত হলে, তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। এ নিয়ে সমাজের সর্বস্তরে সচেতনতা বাড়ালে হয়তো আত্মহত্যার ঘটনা আগামী দিনে কমানো সম্ভব হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement