Education

অঙ্ক নিয়ে পড়তে চাইলে

স্কুল আর কলেজের পড়াশোনায় বিরাট ফারাক। বিশেষত অঙ্কের ক্ষেত্রে। ফলে ভাল নম্বর পেলেই নয়, বিষয়টা জানার ইচ্ছে থাকলে তবেই অঙ্ক নিয়ে পড়া উচিত। পরামর্শ দিলেন পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়স্কুল আর কলেজের পড়াশোনায় বিরাট ফারাক। বিশেষত অঙ্কের ক্ষেত্রে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২০ ০০:০১
Share:

অঙ্ক বিষয়টা আপনার মতে...

Advertisement

ট্যাক্সির নম্বর প্লেট থেকে রকেট সায়েন্স— সবেতেই রয়েছে অঙ্ক। মনে হতেই পারে, হঠাৎ ট্যাক্সির নম্বর প্লেটের কথা তুললাম কেন? কারণ ওই নম্বর প্লেট থেকেই জন্ম হয় ‘হার্ডি-রামানুজন নাম্বার’-এর: ‘১৭২৯’। এটা হল সবচেয়ে ছোট সংখ্যা, যেটাকে দুটো ঘন বা কিউবের যোগফল হিসেবে দু’ভাবে দেখানো যায়। এ বার পড়াশোনার কথায় আসি। এখানে নবম বা দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা যে অঙ্ক শেখে, তা একেবারেই বুনিয়াদি গণিত। বরং, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে তারা যা পড়ে, তা হায়ার ম্যাথামেটিক্সের গোড়ার কথা বলে ধরা যেতে পারে। যদিও হায়ার সেকেন্ডারি পর্যন্ত পরীক্ষায় যে ধরনের প্রশ্ন আসে, সেগুলি অনেকাংশেই তথ্যভিত্তিক। দশটা অঙ্ক প্র্যাকটিস করলে, সেগুলির টেকনিক জানা থাকলে, বাকি দশটাও কষে ফেলা যায়, ছাত্রদের সত্যিকারের জ্ঞান যাচাইয়ের ক্ষেত্রে যা একেবারেই উপযুক্ত নয়। ক্যালকুলেশন অঙ্কের একটা অংশমাত্র। সমস্যা হল, অধিকাংশ ছেলেমেয়েই বিষয়টার গভীরে যেতে চায় না। ভাবে, অঙ্ক বুঝি নেহাত ক্যালকুলেশনের ব্যাপার। শুধু কষতে জানলে হবে না, বিষয়টা শিখতে হলে তার থিয়োরিটাও ভাল করে জানতে হবে।

Advertisement

স্নাতক স্তরে ভর্তি হতে হলে?

সাধারণত সরকারি কলেজ বাদে অধিকাংশ ভাল প্রতিষ্ঠানেই স্নাতক স্তরে ভর্তির ক্ষেত্রে অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে হয়। চেন্নাই ম্যাথমেটিক্যাল ইনস্টিটিউট (সিএমআই)-এ ভর্তি হতে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে হয়। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই)-এ বি স্ট্যাট বা বি ম্যাথ কোর্সে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হওয়া যায়। যে সব ছাত্রছাত্রী একাদশ বা দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়তে পড়তে ‘কিশোর বৈজ্ঞানিক প্রোৎসাহন যোজনা’ (কেভিপিওয়াই)-র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তারা সরাসরি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইআইএসইআর)-এ পড়ার সুযোগ পায়। কেভিপিওয়াই ছাড়াও এখানে ভর্তি হওয়া যায় আইআইটি জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজ্য ও সেন্ট্রাল বোর্ড থেকেও একটা নির্ধারিত নম্বরের ভিত্তিতে এখানকার এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসার সুযোগ থাকে। বিভিন্ন আইআইটি-তেও অঙ্ক নিয়ে পড়াশোনা করা যায়।

স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরে কি বৃত্তি পাওয়ার সুযোগ থাকে?

কেন্দ্রীয় সরকার ইনস্পায়ার স্কলারশিপ, কেভিপিওয়াই-এর মতো নানা ধরনের বৃত্তির ব্যবস্থা করেছে, যাতে অঙ্ক নিয়ে পড়ে পরে গবেষণা করার জন্য উৎসাহিত হতে পারে ছাত্রছাত্রীরা। আবার, যারা দ্বাদশ শ্রেণির পরে অঙ্ক বা বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে রাজ্যের কোনও প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে চায়, তাদের উৎসাহিত করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহযোগিতায় ‘জগদীশ বোস ন্যাশনাল সায়েন্স ট্যালেন্ট সার্চ’ (জেবিএনএসটিএস) স্কলারশিপ দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গ উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্ট মেরিট কাম মিনস’ প্রকল্পে আর্থিক ভাবে দুর্বল পরিবারের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তির ব্যবস্থা আছে। রামকৃষ্ণ মিশনের অধীন বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই সব ছাত্রদের স্নাতক স্তরে স্কলারশিপ দেওয়া হয়। আইএসআই-তে যেমন বৃত্তির ব্যবস্থা আছে। আন্তর্জাতিক স্তরে টেম্পলটন ফাউন্ডেশন মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের কিছু নির্দিষ্ট ধারার গবেষণার জন্য এককালীন ৫০০০ মার্কিন ডলার বৃত্তি দিয়ে থাকে। বৃত্তিটির নাম ‘স্পিরিট অব রামানুজন’।

কেউ যদি অঙ্ক পড়ে তার পর অন্য বিষয়ে হায়ার স্টাডি করতে চায়?

আইএসআই-তে কোয়ান্টিটেটিভ ইকনমিক্স, কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স-এর মতো বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা যায়। অ্যাপ্লায়েড ম্যাথামেটিক্স নিয়ে পড়ার পরে ভবিষ্যতে এরোনটিক্স, অ্যাস্ট্রোফিজ়িক্স, কসমোলজি নিয়ে উচ্চশিক্ষা করা যাবে। অনেকে ক্রিপ্টোগ্রাফি নিয়ে নানা কাজকর্ম করে। অঙ্কের কয়েকটি বিশেষ শাখা, যেমন নাম্বার থিয়োরি বা ইলিপ্টিক কার্ভ-এর প্রয়োজন পড়ে এই বিষয়ে। স্নাতক বা স্নাতকোত্তরের পরে কম্পিউটার সায়েন্সে বি টেক, এম টেকও করে নিতে পারে ছাত্রছাত্রীরা। আবার এমসিএ-ও করা যায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। বিজ়নেস অ্যানালিটিক্সে দু’বছরের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করা যেতে পারে। এটি আইআইএম কলকাতা, আইআইটি খড়্গপুর ও আইএসআই কলকাতা মিলে পরিচালনা করে।

অনলাইন সাইট থেকে কি ছেলেমেয়েরা সাহায্য পেতে পারে?

জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের (যেমন, আইআইটি, এমআইটি ইত্যাদি) নামকরা শিক্ষকদের ব্যক্তিগত ভিডিয়ো চ্যানেল রয়েছে ইউটিউব-এ। অনেকের নিজস্ব ওয়েবসাইট, ব্লগও আছে। তাঁরা সেখানে নিয়মিত তাঁদের লেকচার নোটস (পুরনো এবং বর্তমান), ভিডিয়ো লেকচার আপলোড করে থাকেন। বেশ কিছু ভুয়ো ভিডিয়ো, সাইটও কিন্তু আছে ইন্টারনেটে। সেগুলি বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের সতর্ক থাকতে হবে। ‘Mathematics Stack Exchange’ নামে একটি সাইট রয়েছে, যেখানে কেউ অঙ্কের কোনও প্রশ্ন দিলে, এক গুচ্ছ উত্তর পাবে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে।

শিক্ষক হিসেবে আপনার পরামর্শ...

স্কুল আর কলেজের সিলেবাসের মধ্যে ফারাকটা অনেকখানি। উচ্চ স্তরের অঙ্ক কিন্তু অনেক বেশি অ্যাবস্ট্র্যাক্ট এবং গভীর তাত্ত্বিক ধারণার কারিকুরি। সেখানে বিষয়টা না বুঝলে, ছাত্রছাত্রীদেরই কিন্তু এক সময় অঙ্ক নিয়ে পড়তে আর ভাল লাগবে না। হাতেগোনা কয়েক জনই ভালবেসে অঙ্ক পড়তে আসে। অনেকে আসে স্কুলে এবং উচ্চ মাধ্যমিকে অঙ্কে ভাল নম্বর পেয়েছে বলে। আবার কেউ কেউ আসে ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা ডাক্তারি পরীক্ষায় সুযোগ পায়নি বলে। কলেজ স্তরে পড়াশোনাটা যে হেতু অনেক বেশি তাত্ত্বিক, ফলে তারা পড়ে মুশকিলে। তা ছাড়া, বর্তমান সিবিসিএস পদ্ধতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। সবাই জন্মগত ভাবে সমান মেধাবী হয় না। আগে যখন বার্ষিক পরীক্ষার পদ্ধতি ছিল, তখন এই সব ছেলেমেয়েদের হাতেও পর্যাপ্ত সময় থাকত, নতুন পড়াশোনাকে আয়ত্ত করার। কিন্তু বর্তমান সিবিসিএস পদ্ধতিতে, যখন তখন পরীক্ষা হয় এবং নতুন বিষয়কে আয়ত্ত করতে তুলনামূলক ভাবে কম সময় পাওয়া যায়। ফলে অনেক ছেলেমেয়েরই কোনও রকমে মুখস্থ করে পরীক্ষায় উতরে যাওয়ার ভুল প্রবণতা তৈরি হয়। আমার মতে, ছেলেমেয়েরা যদি শেখার জন্য নিজেদের প্রয়োজনীয় সময় দেয়, তা হলে এদের মধ্যে অনেকেই বিষয়টি ঠিকমতো শিখে ভাল ফল করতে পারে। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থায় সেই সুযোগ কম হওয়ায় আগামী দিনে প্রকৃত অর্থে ভাল ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বহু গুণ কমে যাবে বলে আমার আশঙ্কা। এদের অনেকেই হয়তো পরে স্কুল-কলেজে শিক্ষকতা করবে। তাদের সেই সীমিত জ্ঞানের কারণে শেষ পর্যন্ত ফলভোগ করতে হবে আগামী প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের। তাতে আখেরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভাল হবে কি?

রামকৃষ্ণ মিশন রেসিডেনশিয়াল কলেজ, নরেন্দ্রপুর-এর শিক্ষক

সাক্ষাৎকার: সৌরজিৎ দাস

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement