Engineering students

লক্ষ্য পূরণের পথে

কোভিড-কালের টালমাটাল পরিস্থিতি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রছাত্রীদের সামনে কেরিয়ারের জন্য নিজেদের তৈরি করার সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে এসেছে। কী ভাবে? গ্র্যাজুয়েশনের পরে ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনটে পথ খোলা থাকে। এক, চাকরি; দুই, উচ্চশিক্ষা; এবং তিন, ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত কোর্স।

Advertisement

সুমন্ত নিয়োগী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share:

অতিমারির কারণে সকলেরই জীবন ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। স্কুল-কলেজে গিয়ে ক্লাস করতে এখনও বেশ কিছু দিন দেরি আছে। এই অবস্থায় হয় পড়াশোনা একেবারে বন্ধ করে দিতে হয়, নয়তো নিজে নিজেই পড়তে হয়। আর এ সবের একমাত্র বিকল্প ই-লার্নিং, চাই বা না চাই। ই-লার্নিং’এর সঙ্গে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষক সে ভাবে পরিচিত নন। তার উপর, চার পাশে এক অনিশ্চিত পরিস্থিতি। দুইয়ে মিলে শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে ছেলেমেয়েরা। এই সময়ে মানসিক ভাবে ভাল থাকতে তাই সেই সব কাজই করা উচিত, যাতে তোমরা আগ্রহ পাও। আজ আলোচনা করব এই অতিমারি পরিস্থিতিতে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রছাত্রীরা কী ভাবে আগামী দিনের কেরিয়ারের জন্য নিজেদের তৈরি করতে পারে।

Advertisement

গ্র্যাজুয়েশনের পরে ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনটে পথ খোলা থাকে। এক, চাকরি; দুই, উচ্চশিক্ষা; এবং তিন, ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত কোর্স। শেষ দু’টি ক্ষেত্র তো বটেই, কিছু ক্ষেত্রে প্রথমটাতেও নানা পরীক্ষা দিতে হয়। যেমন গেট, আইইএস, জিআরই, জিম্যাট, স্যাট, ক্যাট ইত্যাদি। তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা এই সময়ে এই সব পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে।

অনেক ছাত্রছাত্রীই ইংরেজিতে নিজেদের ঠিকমতো ব্যক্ত করতে পারে না। যার ফলে অনেকেই ক্যাম্পাসিং-এর সময় অসুবিধায় পড়ে। এখন হাতে যে সময়টা পাওয়া যাচ্ছে, সেটা নিজেদের কমিউনিকেশন স্কিল বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করতে পারো। নানা জায়গায় অনলাইনে ইংরেজির স্বল্পমেয়াদি কোর্স পড়ানো হয়, সেখানে যোগ দেওয়া যায়। ইংরেজির পাশাপাশি ফরাসি, জার্মান, জাপানি বা স্প্যানিশের মতো দু’-একটা বিদেশি ভাষা শেখা থাকলে পরে চাকরি বা উচ্চশিক্ষায় সুবিধা হতে পারে।

Advertisement

অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অঙ্কের উপরে সে ভাবে জোর দেয় না। ফলে উচ্চতর পড়াশোনা করতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা অনেক সময়েই অসুবিধার মধ্যে পড়ে। যারা পরে আরও পড়াশোনার কথা ভাবছ, তারা এখন থেকে এই বিষয়ের উপরে জোর দাও। অঙ্ক সংক্রান্ত প্যাকেজ বা সফটওয়্যারও পাওয়া যায়।

ইঞ্জিনিয়ারিং-এ মেক্যাট্রনিক্স এবং রোবোটিক্স ইন্টারডিসিপ্লিনারি বিষয় হিসেবে ইতিমধ্যেই পরিচিত। এই সব বিষয়গুলি পড়তে মেক্যানিক্স, মেক্যানিজ়মস, ইলেকট্রিক্যাল সায়েন্সেস (বিশেষত মোটর), অ্যাপ্লায়েড চিপ লেভেল ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্স, কম্পিউটার ল্যাঙ্গোয়েজ, কন্ট্রোল থিয়োরি, কম্পিউটার ভিশন ইত্যাদি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিভিন্ন শাখার জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। কিন্তু অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই নিজের বিষয় ছাড়া অন্য কিছু পড়তে চায় না। আমাদের পাঠ্যক্রমও এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, তাতে অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিষয়ের উপরে সে ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদেরই উদ্যোগী হয়ে সিলেবাসের বাইরের বিষয়গুলি জানার চেষ্টা করতে হবে।

ক্লাস না হওয়ার ফলে অনেক জায়গাতেই এখন ওয়েব কনফারেন্স এবং ওয়েব ট্রেনিং প্রোগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে। নানা সংস্থা, যারা বিভিন্ন পেশাদার সফটওয়্যার তৈরি করে, যেগুলি শুধু শিক্ষার জন্য নয় পেশাদার ক্ষেত্রেও ছাত্রছাত্রীদের কাজে লাগে, অনলাইনে ট্রেনিং প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করছে। ছেলেমেয়েরা প্রয়োজনমতো প্রোগ্রামগুলিতে যোগ দিতে পারে। ‘কোর্সেরা’, ‘ইউডেমি’, ‘এডএক্স’-এর মতো বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, অথবা আইআইটি-র এনপিটিইএল প্ল্যাটফর্মের সাহায্য নিতে পারে পড়াশোনায় সাহায্যের জন্য। ইন্টারনেটে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক নামী শিক্ষকের লেকচারও পাওয়া যায়।

ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পড়াশোনায় নানান সফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যার ব্যবহার করা হয়। ছেলেমেয়েরা অনেক সময় অপটু হাতে এগুলি ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারে না। কিন্তু ভুল করতে করতেই এরা ধীরে ধীরে শেখে। এতে তাদের বিষয়ের উপরেও আগ্রহ তৈরি হবে।

সফটওয়্যার

ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পড়াশোনায় তিন ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয়: ১) প্রফেশনাল প্যাকেজ; ২) ফ্রিওয়্যার এবং ৩) ওপেন সোর্স প্যাকেজ। প্রফেশনাল প্যাকেজে স্টুডেন্ট ভার্সান পাওয়া যায়, যেগুলি ছাত্রছাত্রীরা বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারে। ফ্রিওয়্যার এমনিতেই ফ্রি সফটওয়্যার। আর, সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার— দুটি ক্ষেত্রেই ওপেন সোর্স কনসেপ্ট এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

যেমন, ‘ম্যাটল্যাব’ (MATLAB) একটি প্রফেশনাল প্যাকেজ। এতে প্রচুর মডিউল রয়েছে, যা শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং নয়, ইকনমিক্স এবং বিজ়নেস-এর ক্ষেত্রেও কাজে লাগে। তা ছাড়া, এটি বেসিক প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গোয়েজও সাপোর্ট করে। মেক্যানিক্যাল এবং ইলেকট্রিক্যাল সায়েন্সেস-এর অনেক কিছু এর ইঞ্জিনিয়ারিং সংক্রান্ত মডিউলগুলির মধ্যে রয়েছে। ফাজ়ি লজিক, নিউরাল নেটওয়ার্ক, কন্ট্রোল সিস্টেম ডিজ়াইন, ডেটা অ্যাকুইজ়িশন ইত্যাদি মডিউলগুলি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সব শাখার জন্য কাজে লাগে।

অক্টেভ-ও (OCTAVE) ম্যাটল্যাব-এর মতোই ওপন সোর্স প্যাকেজ, যদিও এর মডিউলের সংখ্যা কম। স্কাইল্যাব এবং ফ্রিম্যাট ম্যাটল্যাব-এর বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

‘আনসিস’ (ANSYS) হল একটি প্রফেশনাল ফাইনাইট এলিমেন্ট প্যাকেজ, যেটির সলিড মেক্যানিক্স, ফ্লুইড মেক্যানিক্স, থার্মাল সায়েন্স, ইলেকট্রোম্যাগনেটিজ়ম এবং মেটিরিয়াল সায়েন্সের মতো নানা বিষয়ে মডিউল রয়েছে। এর মডিউল এতটাই বৈচিত্রপূর্ণ যে সিভিল, এরোস্পেস, কেমিক্যাল এবং ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছেলেমেয়েরা এটি ব্যবহার করতে পারে। এটির ফ্রি স্টুডেন্ট লাইসেন্স প্যাকেজও পাওয়া যায়।

‘লিজা’ (LISA) আর একটি ফাইনাইট এলিমেন্ট প্যাকেজ, যেটির আনসিস-এর মতো অত বৈচিত্র নেই। মেকানিক্যাল, সিভিল এবং এরোস্পেস ছাত্রছাত্রীদের কাজে লাগতে পারে।

‘অ্যাডামস’ (ADAMS) হল একটি পেশাদার মাল্টিবডি ডায়নামিক্স প্যাকেজ, যেটি রোবোটিক্সের মতো বিষয়ের পাশাপাশি মেক্যানিক্স এবং মেক্যানিজ়ম-এর মতো বিষয় পড়ার ক্ষেত্রে কাজে লাগে।

কম্পিউটার ল্যাঙ্গোয়েজ হিসেবে ‘পাইথন’ (PYTHOn) বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং এবং সায়েন্স-এর বিভিন্ন শাখায় এর নানা বৈজ্ঞানিক প্যাকেজ তৈরি হয়েছে। ‘টেনসরফ্লো’ (Tensorflow), ‘থিয়ানো’ (Theano) এবং ‘কেরাস’ (Keras) হল এই ল্যাঙ্গোয়েজের কয়েকটি ওপেন সোর্স ডিপ লার্নিং লাইব্রেরি।

আর একটি জনপ্রিয় ওপেন সোর্স প্যাকেজ হল ‘ওপেন মডেলিকা’ (Open Modelica)। মেকানিক্যাল সায়েন্স, থার্মাল সায়েন্স, ইলেকট্রিকাল সায়েন্স ইত্যাদি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর নানা শাখায় পড়াশোনার ক্ষেত্রে এই প্যাকেজ কাজে লাগে।

ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সব শাখাতেই অঙ্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষত যারা উচ্চশিক্ষা করতে চায়, তাদের জন্যে তো বটেই। এর জন্যেও নানা প্রফেশনাল প্যাকেজ রয়েছে। যেমন, ম্যাথমেটিকা (MATHEMATICA), মেপল (MAPLE) ইত্যাদি।

অঙ্কের মতো ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রায় সব শাখা বিশেষত মেকানিক্যাল, এরোস্পেস, কেমিক্যাল, মেটালার্জিকাল এবং ইলেকট্রিকাল-এ কাজে লাগে ড্রয়িং। এ ক্ষেত্রে বহু বছর ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে অটোক্যাড (AUTOCAD)। বর্তমানে কাটিয়া (CATIA), প্রোই (PROE), সলিডওয়ার্কস (SOLIDWORKS) মতো বিভিন্ন পেশাদার প্যাকেজ বাজারে এসে গিয়েছে। ফ্রিক্যাড (FREECAD) একটি ওপন সোর্স সলিড মডেলার। এগুলি ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং শিখতে সাহায্য করে এবং পেশাদার ক্ষেত্রে এর গুরুত্বও রয়েছে।

এলটিস্পাইস (LTspice) হল একটি অ্যানালগ ইলেকট্রনিক সার্কিট সিমুলেটর যেটার সাহায্যে ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের মতো ইলেকট্রনিক সার্কিট তৈরি, সিমুলেট এবং সেটার কাজ যাচাই করতে পারে।

•ইংরেজির পাশাপাশি ফরাসি, জার্মান, জাপানি বা স্প্যানিশের মতো দু’-একটা বিদেশি ভাষা শেখা থাকলে পরে চাকরি বা উচ্চশিক্ষায় সুবিধে হতে পারে।

•অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অঙ্কের উপরে সে ভাবে জোর দেওয়া হয় না। যারা পরে উচ্চশিক্ষার কথা ভাবছ, তারা এখন থেকেই এই বিষয়ের উপরে জোর দাও।

•অনেক জায়গাতেই এখন ওয়েব কনফারেন্স এবং ওয়েব ট্রেনিং প্রোগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে। ছেলেমেয়েরা এই প্রোগ্রামগুলিতে প্রয়োজনমতো যোগ দিতে পারে।

হার্ডওয়্যার

ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনায় বেশ কিছু হার্ডওয়্যারও কাজে লাগে। যেমন, মাইক্রোকন্ট্রোলার (উদাহরণ আরডুইনো, ARDUInO), সিঙ্গল বোর্ড কম্পিউটার (যেমন, র‌্যাস্পবেরি পাই), রোবোটিক্স কিট (লিঙ্কস, মোটর, গিয়ার সহ), মেকারবিম, ওপনবিম, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক কম্পোনেন্ট এবং আই সি (উদাহরণ, আইসি ৭৪১), ওসিলোস্কোপ (যেমন হ্যান্ডটেক, বিটস্কোপ মাইক্রো ইত্যাদি), কমদামি মেমস (MEMS) সেন্সর (ত্বরণ, তাপমাত্রা, চাপ আর চৌম্বক ক্ষেত্র মাপার জন্য)।

যেহেতু ইঞ্জিনিয়ারিং-এর হরেক শাখা, বিভিন্ন বিষয়, সেখানে এই আলোচনা এক জন ছাত্রের কাছে অস্পষ্ট লাগতে পারে। ভাল হয় সে যদি লেখাটা পড়ার পরে শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে। তিনি তাকে ঠিকমতো পথ দেখাতে পারবেন।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক

তথ্য সহায়তা: শিক্ষক অর্ঘ্য নন্দী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement