নিজের ধ্যানধারণা ব্যক্ত করার জন্য মানুষ প্রথমে ছবি আঁকতে শিখেছে। আলতামিরা-র গুহাচিত্র সে সাক্ষ্য দেয়। এর অনেক শতাব্দী পরে মানুষ তৈরি করেছে শব্দ, বর্ণমালা। লিখতে শিখেছে মানুষ। তখন থেকেই শুরু হয়েছে গ্রাফিক ডিজ়াইনের পথ চলা। প্রাচীন সভ্যতার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিগুলোয় চোখ রাখলেই দেখা যাবে সেগুলো ছবি ও লেখাকে সাজিয়ে কোনও তত্ত্ব ব্যাখ্যা বা ব্যক্ত করার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ‘গ্রাফিক’ কথাটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ ‘গ্রাফে’ থেকে, যার অর্থ লেখা ও আঁকা। ডিজ়াইন শব্দের জন্ম লাতিন ও ফরাসি ভাষার হাত ধরে। এর অর্থ কোনও কিছুকে নির্দেশ করা, ব্যক্ত করা বা নির্দিষ্ট আকার দেওয়া। এই দুই শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে গ্রাফিক ডিজ়াইন বিষয়টি কী ও এক জন ডিজ়াইনারের কাজ কী, তার উত্তর।
কোথায় পড়বে
গ্রাফিক ডিজ়াইন নিয়ে প্রথাগত পড়াশোনা করতে হলে প্রথমেই আসবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজ়াইন-এর কথা। বেশ কয়েকটি ক্যাম্পাস রয়েছে এনআইডি-র। রয়েছে স্নাতক (বি ডেস), স্নাতকোত্তর (এম ডেস) কোর্সের সুযোগ। সিমবায়োসিস ইনস্টিটিউট অব ডিজ়াইন, সৃষ্টি ইনস্টিটিউট অব আর্ট, ডিজ়াইন অ্যান্ড টেকনোলজি-র মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও বর্তমানে গোটা দেশেই একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজ়াইন ও ডিজ়াইন সংক্রান্ত কোর্স পড়ানো হয়।
দেশের নামী আর্ট কলেজগুলোয় রয়েছে একাধিক কোর্স, যা ডিজ়াইন শেখার ও পরবর্তী কালে ডিজ়াইনার হিসেবে কাজ করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহায়ক। যেমন, কলকাতার গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট-এ রয়েছে কমার্শিয়াল আর্ট পড়ার সুযোগ। এ ছাড়াও, বিশ্বভারতীর কলাভবন, স্যর জে জে স্কুল অব আর্ট, দ্য মহারাজা সায়াজিরাও ইউনিভার্সিটি বডোদরা-র মতো ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রিন্ট মেকিং বিভাগে পড়লে ডিজ়াইন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা যায়।
বর্তমানে প্রযুক্তিনির্ভর দুনিয়ায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজ়াইনের চাহিদা তুঙ্গে। এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি ইনস্টিটিউটে আন্তর্জাতিক মানের পড়াশোনা ও গবেষণা হয়। আইআইটি বম্বে-র ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজ়াইন সেন্টারের নাম এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া অন্য আইআইটিগুলোতেও রয়েছে ডিজ়াইন শেখার কোর্স।
আঁকা ও গ্রাফিক ডিজ়াইন
অনেকেরই প্রশ্ন থাকে, এক জন সফল গ্রাফিক ডিজ়াইনারের ভাল ছবি আঁকতে জানা জরুরি কি না। উত্তর, হ্যাঁ এবং না। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজ়াইনের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় যেমন ছবি আঁকার বেসিক, যাকে বলা হয় ওয়ার্কিং নলেজ-এ ভীষণ জোর দেওয়া হয়। আধুনিক ছবিতে রেনেসাঁসের সময়কার শিল্পীদের মতো প্রকৃতিকে হুবহু ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার বদলে অনেক বেশি জোর দেওয়া হয় বুদ্ধিমত্তায়— কী ভাবে গল্পটা বলা হচ্ছে— সে ব্যাপারে। সে ক্ষেত্রে ছবির ব্যবহারের পাশাপাশি ছবির কম্পোজ়িশন, ছবির মধ্যে তথ্য নিয়ে খেলা, গ্রাফের ব্যবহার, ছবি-শব্দের ব্যালান্স— সমস্তটাই জরুরি। এক জন ভাল গ্রাফিক ডিজ়াইনারের এ সমস্ত বিষয়ে মুনশিয়ানা থাকা আবশ্যক। তাই দারুণ ছবি আঁকতে জানতেই হবে, এমনটা নয়। বরং ছবির বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার শেখাটাই কাম্য।
কী ভাবে এগোবে
বি ডেস কোর্সে হায়ার সেকেন্ডারির পরেই ভর্তি হওয়া যায়। প্রবেশিকা পরীক্ষা ও ইন্টারভিউয়ে টেকনিক্যাল স্কিলের থেকেও বেশি দেখা হয় প্রার্থীর ক্রিয়েটিভ স্কিল কতখানি। তাই ডিজ়াইন কোর্সের প্রবেশিকা পরীক্ষার কোনও নির্দিষ্ট সিলেবাস নেই। ফলে প্রস্তুতিও বাঁধাধরা হয় না। তবে বিষয়টির ব্যাপ্তি এতটাই বেশি যে, অন্য কোনও বিষয়ে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা করে ডিজ়াইন নিয়ে পড়াশোনা করা ভাল। মনে রাখতে হবে, গ্রাফিক ডিজ়াইনের মূল উদ্দেশ্য ছবি ও শব্দের ব্যবহারের সাহায্যে কোনও কঠিন বিষয়কে সহজ করে বুঝিয়ে দেওয়া। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে স্নাতক স্তরের পরেই কোনও ছেলে বা মেয়ের সেই অভিজ্ঞতা হয়, যেখানে সে জটিল বিষয়কে সহজ ভাবে বোঝানোর দক্ষতা অর্জন করে থাকে। এর ব্যতিক্রম থাকতেই পারে।
কাজের সুযোগ
গ্রাফিক ডিজ়াইন ক্ষেত্রটির কাজের পরিধি বিশাল। ডিজ়াইন স্কুল থেকে পাশ করে বেরনোর পর অনেকেই যোগ দেন অ্যানিমেশন ইন্ডাস্ট্রি বা কোনও বিজ্ঞাপন সংস্থায়। অ্যানিমেশন সিরিজ় বা সিনেমা ছাড়াও সম্প্রতি যে সেক্টরে ডিজ়াইন ও অ্যানিমেশনের ব্যবহার বিপুল পরিমাণে বাড়ছে, তা হল শিক্ষাক্ষেত্র। বেশ কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন সংস্থা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাকে ওয়েবসাইট ও অ্যাপের হাত ধরে এনে দিচ্ছে ঘরের মধ্যেই। এ ক্ষেত্রে টেক্সট বইয়ের তথ্যকে আরও বোঝার উপযোগী করে তোলায় গ্রাফিক ডিজ়াইনারের ভূমিকা অপরিহার্য। গোটা পৃথিবীতেই গ্রাফিক ডিজ়াইনারদের একটা বড় অংশ কাজ করেন বিভিন্ন সংবাদপত্র ও পত্রিকায়। বইয়ের মলাটের ডিজ়াইন থেকে শুরু করে ভেতরের পাতায় ছবি ও লেখার বিন্যাস— পাঠকের কাছে একটি বইকে গ্রহণযোগ্য করার তোলার কাজেও গ্রাফিক ডিজ়াইনারের ভূমিকা থাকে অনেকখানি। তাই বই প্রকাশনা সংস্থাগুলোতেও কাজের সুযোগ রয়েছে।
ডিজ়িটাল দুনিয়ায় ভাল মানের ওয়েব-ডিজ়াইনের চাহিদা যথেষ্ট। বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থায় কমিউনিকেশন ডিজ়াইনারের ভূমিকায় কাজের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে ফ্যাশন দুনিয়ায় কাজের সুযোগ।
এখনও পর্যন্ত গ্রাফিক ডিজ়াইন-এর যতগুলো কর্মক্ষেত্র আলোচনা হল, তা সবই দ্বিমাত্রিক। ত্রিমাত্রিক ডিজ়াইন— তা বাস্তবিক হোক বা ভার্চুয়াল— সেখানেও কাজের পরিধি ক্রমশই বাড়ছে। স্থপতি, ভাস্কর, কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ ও গ্রাফিক ডিজ়াইনারেরা একযোগে কাজ করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজ়াইন, রোবোটিক্স ও স্থাপত্য শিল্পে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছেন। বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করা ছাড়াও অনেক গ্রাফিক ডিজ়াইনারই পছন্দ করেন স্বাধীন ভাবে কাজ করতে। তা ছাড়াও পিএইচ ডি করে অধ্যাপনা ও গবেষণার পথও বেছে নেওয়া যায়।
চেনা ছকের বাইরে
একুশ শতকে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে সীমারেখা প্রায় মুছে গিয়েছে। গ্রাফিক ডিজ়াইনের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। বর্তমানে বিজ্ঞান, শিল্প, ডিজ়াইন, সমাজবিজ্ঞান মিলেমিশে একাকার। আধুনিক ডিজ়াইনাররা নতুন নতুন ক্ষেত্রের উদ্ভাবন করছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এনভায়রনমেন্টাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড ডিজ়াইনের কথা। এই ক্ষেত্রে অন্যতম বড় নাম নেরি অক্সম্যান। এমআইটি-র এই অধ্যাপিকা একাধারে জীববিজ্ঞানী, স্থপতি ও ডিজ়াইনার। তিনি এমন স্থাপত্য সৃষ্টি করছেন, যার প্রেরণা প্রাণী ও উদ্ভিদের তৈরি প্রাকৃতিক ডিজ়াইন। যেমন, মাকড়সার জাল বা গাছের পাতার আভ্যন্তরীণ ডিজ়াইন। এ ছাড়াও বলতেই হয় ড্যান গুডস-এর কথা। নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরিতে কর্মরত এই গ্রাফিক ডিজ়াইনার নিজের পরিচয় দেন ভিস্যুয়াল স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে। তাঁর দলের কাজ হল, নাসার পরবর্তী অভিযানের খুঁটিনাটি ডিজ়াইন করা ও মহাকাশবিজ্ঞানকে আকর্ষণীয় করে তোলা। সুতরাং প্রথাগত কাজের বাইরে বেরিয়েও নতুন কাজ সৃষ্টি করতে পারেন গ্রাফিক ডিজ়াইনাররা।
পিনাকী দে উত্তরপাড়া প্যারীমোহন কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক। এ ছাড়াও তিনি কমিক্স বিশেষজ্ঞ ও বুক ডিজ়াইনার হিসেবে পরিচিত