মিথ ১: বামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধির আর জায়গা নেই।
মিথ ২: মোদী-হাওয়ার ধাক্কায় সব চেনা ছকই এলোমেলো।
মিথ ৩: বিরোধী ভোট ভাগাভাগি হওয়াটাই বামেদের জয়ের রহস্য ছিল।
মিথ ৪: রাজ্যে তৃণমূল মাথাচাড়া দিলে বিপাকে পড়বে বামেরা।
এই সব মিথই এ বার ধরাশায়ী ত্রিপুরায়! পাশের রাজ্য অসম পর্যন্ত মোদী-হাওয়ায় যখন ভেসে গিয়েছে, বাংলাদেশের কোলে এই ছোট্ট রাজ্যে বাম দুর্গ শুধু অটুটই নয়, তাদের শক্তি আরও বেড়েছে। রাজ্যের দু’টি লোকসভা আসনের একটিতে পাঁচ লক্ষ তিন হাজার ৪৮৬ এবং অন্যটিতে চার লক্ষ চুরাশি হাজার ৩৫৮ ভোটে জিতেছেন সিপিএমের দুই প্রার্থী শঙ্করপ্রসাদ দত্ত ও জিতেন্দ্র চৌধুরী। জয়ের ব্যবধান এ বার গোটা দেশে একমাত্র নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তুলনীয়! দুই কেন্দ্রেই আর সব প্রার্থীর জামানত জব্দ! তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য, বামেদের ভোটপ্রাপ্তির হার দাঁড়িয়েছে ৬৪%। গত বছর বিধানসভা ভোটে ৫২.৩% ভোট পেয়ে ত্রিপুরায় ফের ক্ষমতায় এসেছিল বামেরা। এক বছরে ভোট বেড়েছে ১২%।
সারা দেশে বামেদের বেহাল দশার কথা ভাবলে প্রকৃত অর্থেই এখন মরূদ্যান মানিক সরকারের ত্রিপুরা! পশ্চিমবঙ্গে এলাকা ভিত্তিতে সামান্যতম বাম ঘাঁটিও যখন ধূলিসাৎ, মানিকের বাগানে তখন নতুন নতুন ফুল ফুটছে! তৃপ্ত হয়েও উচ্ছ্বসিত নন সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মানিক। তাঁর নিজের রাজ্যের বাইরে কোথায় বামেদের অঙ্ক কেন মিলল না, দলের নেতা হিসাবে উত্তর খোঁজার চেষ্টা তো তাঁকেও করতে হচ্ছে।
ত্রিপুরার সাফল্য আবার একই সঙ্গে এই প্রশ্নও তুলে দিচ্ছে যে, দেশে বিলুপ্তপ্রায় হতে হতে বামেরা কি শেষে মানিকের রাজ্যেই বিরল প্রজাতি হয়ে থেকে যাবে? অর্থনীতি ও রাজনীতির বহু পণ্ডিতই মনে করেন, বামেদের অবলুপ্তির পথে চলে যাওয়ার অন্যতম কারণ ভারতীয় সমাজ, ভারতীয় ব্যবস্থার সঙ্গে একাত্ম হতে না পারা। কমিউনিস্ট পার্টিই এমন এক রাজনৈতিক দল, যারা এখনও দেশের জাতীয় পতাকা তোলে না! সংসদীয় গণতন্ত্রের উপরে নির্ভর করেই তারা বেঁচে আছে। তবু সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে পুরোদস্তুর খাপ খাইয়ে নেওয়ার মতো কর্মসূচি নিতে পারেনি। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ আবার এমনও মনে করেন, এ দেশে শিল্পের গতি যত শ্লথ হয়েছে, শ্রমিক শ্রেণি যত ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে, অসংগঠিত ক্ষেত্র বাড়ায় সঙ্কুচিত হয়েছে কমিউনিস্টদের কর্মক্ষেত্র।
ত্রিপুরা একেবারেই শিল্প-নির্ভর রাজ্য নয়। তবু সেখানে গ্রামীণ রোজগার প্রকল্পের কাজ, রাস্তাঘাটের মতো কিছু বুনিয়াদি উন্নয়ন, প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন এই রকম নানা কাজ করে দেশের একমাত্র বাম সরকারের চাকা সচল রেখে দিয়েছেন মানিক। তাঁর কথায়, “মানুষের আয় বাড়ানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।” সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সততা। বাংলায় লোকসভা ভোটে বিপর্যয়ের পরে অত্যুৎসাহী কিছু সমর্থক যখন ক্ষুব্ধ হয়ে সিপিএম নেতাদের জীবনযাত্রা নিয়ে ফেসবুক থেকে দেওয়ালে প্রশ্ন তুলছেন, মানিকের অনাড়ম্বর জীবন সেখানে এখনও প্রায় বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তাঁর রাজ্যের বিরোধী নেতাদের অবশ্য অভিযোগ, অনেক কিছুই লোক দেখানো! মুখ্যমন্ত্রী নিজে পরিচ্ছন্ন হলেও তাঁর চারপাশে অনেক অসৎ লোক। কিন্তু বিরোধীদের বিশ্বাসযোগ্যতা এতই তলানিতে, এ সব প্রচার বিশেষ হালে পানি পায় না। সেই সঙ্গে ১৯৮৮-’৯৩, পাঁচ বছরের কংগ্রেস জমানায় সন্ত্রাসের স্মৃতি সিংহ ভাগ মানুষকে এখনও বিরোধী-প্রচারের প্রতি শীতলই রেখে দিয়েছে।
রাজ্যে টানা পঞ্চম বারের জন্য বাম সরকারের ইনিংস চালাতে চালাতে লোকসভায় এমন বিপুল সাফল্য উড়িয়ে দেওয়ার তো নয়ই। বিশেষত, বামেদের এমন দুর্দিনে। বিধানসভার সঙ্গে লোকসভা ভোটের ফারাক আছে উল্লেখ করেও মানিক বলছেন, “আমাদের সমর্থনের ভিত আমরা বাড়াতে পেরেছি। সব অংশের মানুষের ভোট পেয়েছি।” গত বার বিধানসভায় ৬০টির মধ্যে ৫০টি আসন জিতেছিল বামফ্রন্ট। লোকসভার হিসাবে ৬০টিতেই এ বার তারা এগিয়ে! আগরতলা শহরের দু’টি বিধানসভা কেন্দ্রে (যেখানে বামেরা বরাবর পিছিয়ে থাকে) শুধু তারা ৫০%-এর কম ভোট পেয়ে জিতেছে। গত বছর কংগ্রেস এবং আইএনপিটি ছেড়ে অনেকে বামে ভিড়েছিলেন। সংগঠন প্রসার এবং সরকারের কাজে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে পারাই সাফল্যের রহস্য বলে মুখ্যমন্ত্রী মনে করছেন।
ভোটের আগে ত্রিপুরায় গিয়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে এসেছিলেন, রাজ্যের দু’টির মধ্যে একটি লোকসভা আসন তাঁদের চাই। লোকসভায় জামানত খোয়ালেও পশ্চিম ত্রিপুরা কেন্দ্রের মধ্যে ৭টি এবং পূর্ব ত্রিপুরা কেন্দ্রের মধ্যে পাঁচটি মোট ১২টি বিধানসভা এলাকায় দ্বিতীয় স্থানে শেষ করতে পেরেছে তৃণমূল। তাদের লক্ষ্য এখন ২০১৮। তার আগে জুলাইয়েই অবশ্য সে রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট আসছে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “এখনও পর্যন্ত তৃণমূলের ভোটটা কংগ্রেস থেকেই বেরোনো ভোট। পঞ্চায়েতে আমরা আশাবাদী।”
আশা তো একমাত্র মরূদ্যানেই!