ফোনে কথাটা পাড়তেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন কংগ্রেসের নেতাটি। “না! না! ফোনে নয়। বাড়িতে আসুন।”
নেতাটি জাতীয় রাজনীতিতে পরিচিত মুখ। মনমোহন মন্ত্রিসভার সদস্যও ছিলেন। সেই তিনিই বললেন, “এ ব্যাপারে আমরা নিজেদের মধ্যেও ফোনে কথা বলছি না। যদি কেউ আড়ি পাতে!”
যদি ১২৫ বছর পূর্তিতে টিম নরেন্দ্র মোদীর হাতে পুরোপুরি ‘ছিনতাই’ হয়ে যান দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু!
তাই এত ফিসফাস। এত রাখঢাক গুড়গুড়। নেহরু-জয়ন্তী উপলক্ষে আগামী ১৪ নভেম্বর ও তার পরের ক’দিনে সনিয়া গাঁধীর সবিস্তার কর্মসূচি বিপক্ষ শিবিরের হাতে পড়া রুখতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন দলের নেতারা। সকাল-সন্ধে ওয়ার রুমে তাঁরা আলোচনা করছেন। সে বাড়িতে কাকপক্ষীরও প্রবেশ মানা। এমনকী বিনা নোটিসে যদি আপনি এঁদের কারও ঘরে ঢুকে পড়েন, দেখবেন নেতা চকিতে ঝপাস করে উল্টে দেবেন সামনের টেবিলে রাখা ফাইল।
ভয়। আতঙ্ক। নিরাপত্তাহীনতা। সন্দেহবাতিক। নেহরুর জন্মদিন পালন নিয়ে অদ্ভুত ও নজিরবিহীন এক দমবন্ধ টেনশন এখন কংগ্রেস দফতরে।
এখনও পর্যন্ত ঠিক রয়েছে, ১৪ তারিখ নয়াদিল্লির তালকাটোরা স্টেডিয়ামে গোটা দলকে নেহরুর সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে পুনরায় উৎসর্গ করার শপথ নেবেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী। তার পর ১৭ ও ১৮ তারিখ নেহরু-স্মরণে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হবে বিজ্ঞান ভবনে।
তাতে এত আতঙ্কের কী হল? দেখা হতে নেতাটি (যিনি নেহরু জয়ন্তী উদযাপন কমিটির সদস্যও বটে) চোখ গোল গোল করে বললেন, “ভাবতেও পারবেন না, ওঁরা ভাঙচি দিতে চাইছেন।” ওঁরা মানে! “বিজেপি!”
জানা গেল, নেহরুর সম্মানে আয়োজিত সম্মেলনে কয়েক জন রাষ্ট্রনেতা ও আন্তর্জাতিক স্তরের কিছু বিশিষ্ট জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই আমন্ত্রণ তাঁরা গ্রহণও করেছিলেন। কিন্তু দু’দিন যেতে না যেতেই অপারগতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। কংগ্রেস নেতাদের দাবি, এমন একের পর এক ঘটনা থেকেই পোড়া গন্ধ লাগছে নাকে। সন্দেহের উদ্রেক হচ্ছে। তাই কে কে আসছেন, কাকে কাকে ডাকা হচ্ছে, সবটা নিয়েই এখন চূড়ান্ত গোপনীয়তা, পাছে বিজেপি জেনে যায়!
কিন্তু বিজেপিই বা কেন ভাঙচি দেবে? কংগ্রেস নেতাদের ব্যাখ্যা হাজারটা কারণ আছে।
সনিয়া যে নেহরুর দর্শনকে সামনে রেখে নিজের হারতে হারতে হতোদ্যম হয়ে পড়া দলকে চাঙ্গা করতে চাইছেন, নরেন্দ্রভাই মোদীর সেটা অজানা নয়। তিনি সুকৌশলে সনিয়ার থেকে সেই অস্ত্রটিও কেড়ে নিতে চাইছেন। যে কারণে ইতিমধ্যেই নেহরু জয়ন্তী পালনে একটি সরকারি কমিটি গঠন করেছেন তিনি। এ ছাড়া স্মারক মুদ্রা প্রকাশ হচ্ছে, ১৪ নভেম্বর ‘শিশু স্বচ্ছতা অভিযান’ শুরু করার ঘোষণাও করেছেন মোদী। কিন্তু এর পরেও যদি তিনি নতুন তাস ছাড়েন? যদি এমন কিছু একটা করে বসেন, যাতে কংগ্রেসের গোটা আয়োজন জোলো হয়ে যায়! এই ঝুঁকি কে নেবে?
এই অবস্থায় আশ্চর্য কী যে, কমিটির এক সদস্য বলবেন, “মোদীর চমক ও গিমিকের কাছে আগেই হার মেনেছে কংগ্রেস। ওঁর পেটে পেটে কী আছে কে জানে!” কংগ্রেসের নেহরু জয়ন্তী উদযাপন কমিটির সভানেত্রী তথা দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত থেকে সাধারণ সদস্য সকলের মুখে কুলুপ। কারও কারও সন্দেহ, এই পরিস্থিতিতে নেহরু জয়ন্তীর একেবারে আগের মুহূর্তে হয়তো আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি ঘোষণা করবে কংগ্রেস, যাতে তার অনুকরণ বা পাল্টা চাল দেওয়ার মতো যথেষ্ট সময় টিম মোদী না পায়!
বিপক্ষ শিবির ভাঙচি দেওয়ার মতো মারাত্মক অভিযোগ করছে। শুনে বিজেপির এক নেতা (নামটা বলা গেল না) প্রবল তাচ্ছিল্যে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললেন, “আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ওই ভারী ভারী কথা কংগ্রেসেরই ক’জন বসে শোনেন, আমরাও দেখব!”
বিজেপি মুখপাত্র শাহনওয়াজ হুসেন হেসে প্রায় গড়িয়েই পড়ছিলেন। তার পর বললেন, “ধুর! খেয়েদেয়ে কাজ নেই, বিজেপি ভাঙচি দেবে কেন? দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন পালন সরকারও করবে। এর মধ্যে বিরোধ কোথায়!” একটু থেমে বিষাক্ত ইনসুইঙ্গার দিলেন শাহনওয়াজ, “নেহরুর প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, উনি এসে তো দল চালাবেন না। সেই তো চালাবেন রাহুল গাঁধী! বিজেপি ভয় পাবে কেন!”
ভয় হয়তো নয়। তবে প্রকাশ্যে যে ভাবে ফুৎকারে সনিয়া-রাহুলের কর্মসূচিকে উড়িয়ে দিচ্ছেন শাহনওয়াজরা, নিজেদের টিম মিটিংয়ে তাকে ততটাই অবজ্ঞা করছেন কি? প্রশ্নটা তুলছেন দিল্লির রাজনীতির অলিন্দে ঘোরাফেরা করা কেউ কেউ। এঁদের মতে, বিপক্ষের সম্ভাব্য পদক্ষেপ মেপেই নিখুঁত নীল নকশা ছকে এগোচ্ছেন মোদী। প্রথমেই বল্লভভাই পটেলকে কংগ্রেসের থেকে ‘ছিনতাই’ করে ফেলেছেন। গাঁধীজির জন্মদিনে ঝাড়ু হাতে নিজে রাস্তায় নেমেছেন। ‘গাঁধী-নেহরু’র উপর কংগ্রেসের একচেটিয়া অধিকারে ভাগ বসিয়ে মোদী এক দিকে নিজের তথা বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। অন্য দিকে স্বাধীন ভারতের যা কিছু সুফল, তার কৃতিত্ব যে শুধুই গাঁধী-নেহরু পরিবারের নয়, তা বোঝাতে বল্লভভাই পটেল, লালবাহাদুর শাস্ত্রী, দীনদয়াল উপাধ্যায়দের অবদানের কথা বলছেন বারবার। অর্থাৎ ট্রেডমার্ক মোদী। এক ঢিলে দুই পাখি। কৌশলের পাল্টা কৌশল। যেমন হয় প্রেমে, যুদ্ধে এবং রাজনীতিতে।
তা হলে কংগ্রেসও তো পারে চ্যালেঞ্জটা নিতে। ‘চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে’ মার্কা আতঙ্কে না ভুগে মোদীকে পাল্টা তাক লাগিয়ে দেওয়ার পথ খুঁজছে না কেন রাহুল-বাহিনী? প্রশ্নটা রাখা গেল মনোবিদদের কাছে। তাঁদের এক জন বললেন, এ আসলে পরাজিতের চুরমার হয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাসের দোষ। যেখানে ‘নিজে কী করতে পারি’র চেয়ে বড় হয়ে ওঠে ‘অন্য কেউ আমার চেয়ে ভাল করে ফেলবে না তো?’ আর এক মনোবিদ, নীলাঞ্জনা সান্যাল যাকে বলছেন ‘দুশ্চিন্তা থেকে তৈরি হওয়া আচরণ’।
দিল্লির মসনদ গিয়েছে। একের পর এক রাজ্যের রাজ্যপাটও যাচ্ছে। ভূগোলের মানচিত্রে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে কংগ্রেস। এখন ইতিহাসটাও রক্ষা না করতে পারলে আর কী থাকবে! বর্গির হানা রুখতে তাই আতঙ্কের ব্যারিকেড!