কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র বলে, শত্রুকে তখনই আঘাত করবে, যখন সে দুর্বল। আজ যে বিপুল জনমত নিয়ে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এলেন, তার পর দলের অন্দরে যাঁরা তাঁর বিরোধী, তাঁরা যাতে আর কোনও রকম বেগড়বাই না করেন, সে জন্য আজই তাঁদের সতর্কবার্তা দিয়ে রাখল দল। যাতে তাঁরা আর তেমন মুখ না খোলেন। মোদীর এই বিপুল জয়ের পরে নাগপুরের পক্ষেও খুব বেশি সরব হওয়ার সুযোগ থাকল না।
গত আট মাসের অক্লান্ত প্রচার ও নিখুঁত কৌশলে আজ ইতিহাস গড়লেন মোদী। এর পরেই বিজেপি নেতারা বলছেন, ভোটের আগেই জনতার কাছ থেকে এক ধরনের নৈতিক কর্তৃত্ব অর্জন করে নিয়েছিলেন মোদী। ভোটের ফল বেরোনোর পর সেটা বেড়ে গেল আরও কয়েক গুণ। যার ফলে এখন শরিকদের উপরেও তাঁর কোনও নির্ভরতা থাকল না। মন্ত্রিসভা গঠনের কাজটিও অনেক সোজা হয়ে গেল তাঁর পক্ষে। তাঁর সরকারের কাজকর্মে দাপট ফলাতে পারবে না দেশের আমলাতন্ত্র। সঙ্ঘের পক্ষেও আর নাক গলানো সম্ভব হবে না সরকারি বিষয়ে।
স্বাভাবিক লালকৃষ্ণ আডবাণী বা সুষমা স্বরাজদের খুব বেশি উৎসাহিত হওয়ার কারণ নেই এতে। তাই দলের সমর্থক-কর্মী-নেতারা যখন উল্লাসে মত্ত, তার মধ্যেও আডবাণী-সুষমারা কিন্তু মোদীকে ঢালাও সার্টিফিকেট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। উভয়ে প্রায় একই সুরে বলেন, “এত বড় জয় আগে কখনও হয়নি। এই জয় বিজেপি-র। তবে এই জয় কংগ্রেসের দুর্নীতি ও কুশাসনের প্রতিক্রিয়া কি না তা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। নাকি এই জয় মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করার জন্য বা আরএসএসের কর্মীদের নিরলস পরিশ্রমের ফসল, সে সবও ভবিষ্যতের বিবেচ্য।” গোটা দল যখন মোদীকেই গোটা জয়ের কৃতিত্ব দিচ্ছেন, সেই সময় দলের বেসুরো এই নেতারা সুকৌশলে আরএসএসের সঙ্গে মোদীর বিবাদ বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। সেই সঙ্গে সঙ্ঘের কাছাকাছি আসারও চেষ্টা করছেন আডবাণী ।
বিজেপি-র শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, ভবিষ্যতে কী হবে সে আলাদা কথা, তবে মোদী সঙ্ঘের সঙ্গে সংঘাতে যেতে চান না। সকলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই এগোবেন তিনি। সঙ্ঘের পক্ষ থেকেও আজ জানিয়ে দেওয়া হয়, মোদীর সরকারে হস্তক্ষেপ করবে না আরএসএস। দলের নেতা রাম মাধব বলেন, “মন্ত্রিসভা গঠনেও সঙ্ঘের কোনও হস্তক্ষেপ থাকবে না।” কিন্তু মোদী সম্পর্কে দলে যাঁদের আপত্তি ছিল, তাঁরা যাতে একেবারে কোণঠাসা না হয়ে যান, নজর রাখা হচ্ছে সে দিকেও। এবং এ কথা মাথায় রেখেই ফল প্রকাশের আগেই মোদীর পরামর্শে রাজনাথ সিংহ, নিতিন গডকড়ীরা আডবাণী-সুষমাদের সঙ্গে দেখা করে আসেন। কিন্তু তাতেও বিপত্তি মেটেনি।
সুষমা কালই জানিয়েছিলেন, তিনি মন্ত্রিসভায় যেতে চান না। আজ তিনি নতুন প্রশ্ন তুলেছেন। সুষমার সঙ্গে অরুণ জেটলির সম্পর্ক কোনও দিনই ভাল নয়। অমৃতসরে জেটলির পরাজয়ের পর দলের মধ্যে সুষমা প্রশ্ন তুলে বসেছেন, এক জন পরাজিত ব্যক্তিকে কেন মন্ত্রিসভায় নেওয়া হবে? তাতে নেতিবাচক বার্তা যাবে। রাজনাথ কিন্তু জানিয়েছেন, “জেটলির প্রতিভাকে উপযুক্ত ভাবে ব্যবহার করা হবে।” যদিও রাজনাথ স্পষ্ট করেননি, জেটলিকে অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব দেওয়া হবে কি না। কিন্তু দলের নেতাদের মতে লোকসভা ভোটে হারার কারণে রাজ্যসভার এই নেতাকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া হবে না, এটা হতেই পারে না। তবে এই সবই এখন মোদীর হাতে।
সঙ্ঘের সঙ্গে জেটলির সম্পর্ক ভাল। তবে সঙ্ঘের পক্ষেও এখন খুব বেশি সরব হওয়ার সুযোগ নেই। এক সময় প্রমোদ মহাজন, যশোবন্ত সিংহ হেরে যাওয়ার পরেও অটলবিহারী বাজপেয়ী তাঁদের মন্ত্রিসভায় নেননি সঙ্ঘের আপত্তিতে। প্রমোদকে সেই সময় রাজনৈতিক সচিব করা হয়। আর যশোবন্ত সিংহকে যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। পরে অবশ্য যশোবন্তকে মন্ত্রিসভায় নিয়ে আসেন বাজপেয়ী। কিন্তু মোদী এখন থেকেই কৌশল মেনে ধাপে ধাপে এগোচ্ছেন। ফল প্রকাশের আগেই আডবাণীকে স্পিকার পদের প্রস্তাব দিয়েছেন। এক সময় বাল ঠাকরে মনোহর জোশীকে স্পিকার করে তাঁকে সেখানেই ব্যস্ত রেখেছিলেন। মোদীও একই ভাবে আডবাণীকে সরকারের কাজকর্ম থেকে দূরে রাখার কৌশল নিতে চাইছেন। বিজেপি নেতারা জানেন আডবাণী মেনে নিলে সুষমার বিদ্রোহও আর ধোপে টিকবে না।