পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঢাকা সফরের আগে, সে দেশের হিংসাত্মক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার পঙ্কজ সারন। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে দেশজুড়ে অবরোধ ও হিংসা চললেও পরিস্থিতি এমন জায়গায় যায়নি যে হাসিনা সরকারকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হবে। বরং রিপোর্টে আশাই করা হয়েছে, রাজনৈতিক ও প্রসাশনিক ব্যবস্থার মাধ্যমেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সফল হবে বাংলাদেশ সরকার।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অশান্তি নিয়ে উদ্বেগে সাউথ ব্লক। কিন্তু বিদেশ মন্ত্রক মনে করে, এর চেয়ে খারাপ পরিস্থিতি সফল ভাবে সামলে এসেছে শেখ হাসিনার সরকার। এ বারও তারা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সফল হবে। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন গত সপ্তাহে বলেন, “বাংলাদেশের সমস্যা একান্তই সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমরা আশা করব, ও দেশের মানুষ ও সরকার নিজেরাই তা সমাধানে সফল হবে।” আকবরউদ্দিনের কথায়, বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার রয়েছে। তাদের সমস্যা নিয়ে অন্য দেশের কিছু বলা বা উপদেশ দেওয়ার অবকাশ নেই।
কিন্তু এই অশান্তির প্রেক্ষাপটেই ঢাকা সফরে যাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাই পরিস্থিতি পর্যালোচনার একটা দায় কেন্দ্রের থেকেই যায়। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে নয়াদিল্লিতে বৈঠকে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারি সূত্রের খবর, সেই বৈঠকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে কেন্দ্রকে বিশদে অবহিত করেছেন সারন। পরিস্থিতি নিয়ে একটি রিপোর্টও তিনি তুলে দিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে ফেনি, চট্টগ্রাম, যশোর, নড়াইল, বরিশাল, রংপুর, মাগুরার মতো কিছু এলাকা সংঘর্ষ কবলিত। থমথমে ঢাকাও। কিন্তু প্রশাসন কঠোর ভূমিকা নেওয়ায় বিএনপি-জামাত কর্মীরা সে ভাবে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শনের পথে হাঁটছে না। ফলে রাজধানীর জনজীবনে তাদের আন্দোলনের তেমন কোনও প্রভাব পড়ছে না। তা ছাড়া সরকারি নিরাপত্তায় মোড়া থাকবে মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি-বহর। তাই এই সফর নিয়ে তেমন কোনও দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
সরকারি সূত্রের খবর, হাই কমিশনারের রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে বিএনপি-জামাত কর্মীদের এই সন্ত্রাস ও চোরাগোপ্তা পেট্রোল বোমা হামলার ঘটনায় বিভিন্ন ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের মদত থাকতে পারে। কিন্তু ভারতীয় দূতাবাস মনে করছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জরুরি অবস্থা জারির পথে হাঁটছেন না। প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক পথেই তিনি সঙ্কট নিরসন চান। আশা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
মমতার ঢাকা পৌঁছনোর কথা ১৯ তারিখ সন্ধ্যায়। ২০ তারিখ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অন্য কিছু সরকারি নেতার সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। সে দিনই রাত বারোটার সময় শহিদ মিনারে গিয়ে পুষ্পস্তবক দিয়ে ভাষা শহিদদের স্মরণ করবেন মমতা। পর দিন, অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের বিকেলেই কলকাতা ফিরবেন মুখ্যমন্ত্রী। ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একটি দল ঢাকা ঘুরে পরিস্থিতি দেখে এসেছেন। অনুষ্ঠানসূচি নিয়ে প্রাথমিক আলোচনাও হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত প্রতিনিধিদের নিরাপত্তার দিকটি নিশ্ছিদ্র করতে সব রকম ব্যবস্থা নিচ্ছে বাংলাদেশ সরকারও। ভাষা দিবসের দিন ঢাকায় হাজির থাকবেন বিভিন্ন বিদেশি অতিথিরা। কোনও রকম অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করতে চাইছে প্রশাসন।
তবে নয়াদিল্লির তরফে কূটনৈতিক চ্যানেলে ঢাকার পরিস্থিতির উপর নজর রাখা হচ্ছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রে কোনও বড় ধরনের অশান্তি ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। গত অক্টোবরে বর্ধমানে বিস্ফোরণের সঙ্গে জামাতুল মুজাহিদিন জঙ্গিদের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় বিষয়টির স্পর্শকাতরতা আরও বেড়ে গিয়েছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে তাই সার্বিক ভাবে আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। সূত্রের খবর, পঙ্কজ সারনের রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে ২০১৩-র ডিসেম্বরে জামাতে ইসলামি বাংলাদেশে যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, এখনকার নাশকতার মাত্রা তার তুলনায় অনেকটাই কম। সে সময় নির্বাচন দোরগোড়ায় ছিল। আন্তর্জাতিক চাপও প্রবল ছিল হাসিনার উপর। কিন্তু শেখ হাসিনা সে সমস্যার সফল মোকাবিলা করেছিলেন। এ বার নাশকতা দমনে হাসিনা প্রশাসন সব দিক থেকেই প্রস্তুত বলে মনে করছে নয়াদিল্লি।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, অবরোধ ও সন্ত্রাসের ফলে বিএনপি-জামাত জোটের ওপর মানুষ বীতশ্রদ্ধ। এক মাসে তাদের কর্মীদের ছোড়া পেট্রোল বোমায় এ পর্যন্ত ৭০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের ২ তারিখ বাংলাদেশের দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষা শুরু হয়েছে। সরকার বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও খালেদা জিয়া অবরোধ প্রত্যাহার করেননি। উল্টে হরতাল ডেকেছেন। ভারতীয় দূতাবাস মনে করছে, মাত্রাছাড়া দুর্ভোগের কারণে এই নেতিবাচক আন্দোলন মানুষের থেকে বিএনপি-জামাতকে ক্রমশই দূরে ঠেলে দিচ্ছে।