দেশের নানা সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে আলোচনা করতে সোমবার দিল্লি গিয়েছিলেন আমির খান। তাঁর দাবি, বিষয়গুলি খতিয়ে দেখবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ছবি: পিটিআই।
এক মাস হতে আর দু’দিন বাকি। আগামী দিনগুলিতে কোন পথে চলবে সরকার, এর মধ্যেই তার রূপরেখা চূড়ান্ত করে ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মন্ত্রী, আমলা, দলকে বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর পথ চলার সাত দফা দাওয়াই।
মন্ত্রিসভার এক শীর্ষ সদস্যের মতে, এই সাতটি মন্ত্রেই লুকিয়ে রয়েছে মোদীর যাবতীয় রসায়ন। ইউপিএ জমানায় তিনটি বড় দুর্বলতা ছিল মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি ও নীতিপঙ্গুত্ব। এই তিনটি বিষয়ের বিরুদ্ধেই মুখর হয়েই মোদী বিপুল জনমত নিয়ে সরকারে এসেছেন। ফলে ইউপিএ আমলের এই ত্রিফলা ব্যর্থতা দূর করার দায় রয়েছে এই সরকারের। কিন্তু শুধু সমস্যা কাটানোয় থেমে না গিয়ে প্রশাসন চালানোর নিজস্ব ভঙ্গিতে মোদী তাঁর সরকারের কাজকর্মকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিতে চান। কুর্সিতে বসার প্রথম মাসেই সেই পথনির্দেশিকা তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
কী সেই সাত দফা দাওয়াই?
সরকারি সূত্র বলছে, এক নম্বর অবশ্যই মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতিকে দাঁড় করানো। প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন, এর জন্য প্রথম থেকেই যে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এই ক্ষেত্রে তাঁর পয়লা পদক্ষেপ ছিল রেলের ভাড়া ও মাসুল বাড়ানো। এর পরের লক্ষ্য মূল্যবৃদ্ধি কমানো। যখন যে পণ্যের দাম বাড়ছে, সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে দীর্ঘমেয়াদি কিছু পদক্ষেপও করবে সরকার। ঢেলে সাজা হবে সরবরাহ ও বন্টন ব্যবস্থাকে। এর সঙ্গে কৃষি ও শিল্প, পরিকাঠামোর প্রসার এবং গ্রাম-শহরের উন্নয়নের রূপরেখা ইতিমধ্যেই পেশ করেছেন মোদী। বাজেটে আরও সবিস্তার উল্লেখ থাকবে তার। মোদীর লক্ষ্য, ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে দু’বছরের মধ্যে পারলে দৌড় করানো।
দুই, মানুষের রোজকার হাজারো সমস্যা মেটানোর চেষ্টা। জোট বাধ্যবাধকতায় ইউপিএ সরকার অনেক সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হত। বিপুল জনমতের ভিতে দাঁড়িয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে কুণ্ঠাবোধ করার কারণ নেই মোদী সরকারের। কিন্তু কড়া সিদ্ধান্ত নিলেই বিরোধীরা, এমনকী শরিকরাও মানুষের দুর্দশা নিয়ে সরব হবে। যেমন বিরোধীরা বলছেই, শরিক শিবসেনাও এখন রেলের ভাড়া বাড়ানোর বিরুদ্ধে মুখ খুলছে। এই সব আক্রমণ ভোঁতা করে দেওয়া যাবে মানুষে নিত্যদিনের সমস্যা মিটতে শুরু হলে। রেল বা বিমান পরিষেবা নিয়ে ক্ষোভ, পেনশন বা চিকিৎসা পেতে গিয়ে হয়রানি এ সব দিকে তেমন নজর দিত না আগের সরকার। এ বার ছবিটা পাল্টাতে চাইছেন মোদী। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় জানাচ্ছে, এই ধরনের সমস্যা দ্রুত মেটানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী একটি বিশেষ সেল গঠন করেছেন তাঁর দফতরে। নির্দেশ, নিয়মিত বৈঠক করে এই সব সমস্যা দ্রুততার সঙ্গে মেটাতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও যে সব অভিযোগ আসছে, সেগুলি সমাধানেও তৎপর হবে সরকার।
তিন, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে মর্যাদা দিয়ে রাজ্যগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ও তাদের সমস্যাগুলিও মেটানোর জন্য নিয়মিত আলোচনার দাওয়াই দিয়েছেন মোদী। প্রধানমন্ত্রী ও সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মিলে একটি ‘টিম ভারত’ তৈরি করার কথা বলেছেন বারবার। তা বাস্তবায়িত করার জন্য মন্ত্রী ও আমলাদের মোদী স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন, রাজ্য থেকে কোনও দাবি বা সমস্যা এলেই সেটি খতিয়ে দেখে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। তা সে যে দলেরই সরকার হোক না কেন। প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের আমলাদের মোদী নির্দেশ দিয়েছেন, রাজ্যের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা ও তিন মাসে পরে ফের বিষয়টি পর্যালোচনা করতে হবে।
চার, দলকেও পাশে নিয়ে চলবে সরকার। মোদী জানেন, তাঁর সরকারি সিদ্ধান্তগুলি কার্যকর করতে হলে দলের সাহায্যও প্রয়োজন। সরকারের কঠোর সিদ্ধান্তে মানুষ যাতে ভুল না বোঝে, বিরোধীরা যাতে বিজেপির রাজনৈতিক পরিসর দখল না করে, তার জন্য দলকেও সক্রিয় হতে হবে। মোদী নিজে দলের সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। চলতি সপ্তাহের শেষে দলের সাংসদদের সঙ্গেও বসবেন মোদী। সেখানে তিনি বোঝাবেন, দু’টি বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হবে দলকে। এক, জনতার প্রতিনিধি হয়ে মানুষের সমস্যা সরকারের কানে পৌঁছে দিতে হবে। দুই, সরকারের কাজের কথা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। ইতিমধ্যেই মন্ত্রীদের তিনি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জনতার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। মোদীর বক্তব্য, সঙ্ঘ ও দলকেও এ বিষয়ে সক্রিয় হতে হবে।
পাঁচ, ইউপিএ জমানার নীতিপঙ্গুত্ব ঝেড়ে ফেলে মন্ত্রী ও আমলাদের সব বিষয়েই চটজলদি সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন মোদী। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর বলেন, “মোদী আমাদের বলেছেন, ‘দেরি’ শব্দটাই সরকারের অভিধান থেকে মুছে ফেলতে হবে। ইউপিএ আমলে এমনও হয়েছে যে, স্রেফ একটা সইয়ের অপেক্ষায় প্রকল্প আটকে রয়েছে। সেগুলি আমরা পর্যালোচনা করে সঙ্গে সঙ্গেই ছাড়পত্র দিচ্ছি। দায়িত্ব ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার মন্ত্রই দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।”
ছয়, দুর্নীতিকে কোনও ভাবেই বরদাস্ত করবেন না, মোদী তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন। মন্ত্রিসভা গঠনের পরই ব্যক্তিগত সচিব নিয়োগের ব্যাপারে রাশ নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এমনকী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের দফতরের কর্মীকেও সরিয়ে দিয়েছেন। তা নিয়ে দলে অনেকের মনে কিছুটা উষ্মাও তৈরি হয়েছে। আবার রাজনাথকে সঙ্গে নিয়েই মন্ত্রিসভার নিয়োগ কমিটি তৈরি করেছেন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রী-আমলারা যাতে অকারণে বিদেশ সফর না করেন, সে বিষয়েও সতর্ক প্রধানমন্ত্রী। তাঁর নির্দেশে এ মাসের গোড়াতেই ক্যাবিনেট সচিব অজিত শেঠ সব মন্ত্রী ও আমলাকে বিদেশে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অনুমোদন নিতে হবে বলে জানিয়েছিলেন। তাতে পরিস্থিতি তেমন বদলায়নি দেখে ফের চিঠি লিখেছেন ক্যাবিনেট সচিব। জানিয়েছেন, বিদেশ সফর নিয়ে প্রধানমন্ত্রী অখুশি। অন্তত দশ দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিতে হবে। মন্ত্রীদেরও জানাতে হবে ১৫ দিন আগে। আগাম জানাতে হবে ব্যক্তিগত কারণে বিদেশে গেলেও।
সাত, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নিরাপত্তাকেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। শপথে সার্ক রাষ্ট্রপ্রধানদের ডেকে মোদী তাঁদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছিলেন। মজবুত অর্থনীতি ও শক্তিশালী নিরাপত্তার ভিতে দাঁড়িয়ে তিনি বিশ্বের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দিতে চান তিনি। গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি জওয়ানদের হাতে আধুনিক সরঞ্জাম তুলে দেওয়া, প্রতিরক্ষায় পুরনো ও অপর্যাপ্ত সরঞ্জামের অভিযোগ দূর করার দিকে জোর দিচ্ছেন তিনি। তিন সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করে মোদী স্থির করেছেন, দেশের প্রতিরক্ষাকে আরও দক্ষ করে তোলা হবে। তিনি নিজে প্রতি মাসে বৈঠক করবেন সেনাপ্রধানদের সঙ্গে। পূর্বসূরি মনমোহন সিংহ যেটা সচরাচর করতেন না।