জোট রাজনীতির মধ্যে প্রথম ‘একলা চলো’র পরীক্ষায় নেমেছিলেন রাহুল গাঁধী। কিন্তু চার বছর আগে বিহার বিধানসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের ফলে তাঁর সেই জুয়া মুখ থুবড়ে পড়ে। এখন সেই একই পথে চলতে চাইছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটি। রাজনীতিকরা যাকে রাহুলের তত্ত্ব ‘হাইজ্যাক’ করে নেওয়া বলেই উল্লেখ করছেন। মোদী-অমিতের প্রথম পরীক্ষা মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানায়। বুথ ফেরত সমীক্ষা জানাচ্ছে, সসম্মানে ‘লেটার মার্কস’ পেয়ে পাশ করে যাওয়ার কথা তাঁদের। তা-ই যদি হয়, তা হলে জোট রাজনীতির পর্বকে পিছনে ফেলে পুরনো অধ্যায়কে ফের ফিরিয়ে আনতে চলেছে বিজেপি। এবং তা-ও প্রায় ২৫ বছর পর।
কেন্দ্রে জোট রাজনীতির প্রথম সফল পরীক্ষা কিন্তু বিজেপিরই আমলে। অটলবিহারী বাজপেয়ী বহুদলীয় সরকার চালিয়েছিলেন সুচারু ভাবে। আর আড়াই দশক আগে মহারাষ্ট্রে প্রথম শিবসেনার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল বিজেপি। সে দিক থেকে এ বারে মহারাষ্ট্রে উদ্ধব ঠাকরের দলের সঙ্গে যাবতীয় যোগ ছিন্ন করে ভোটের ময়দানে নামা অন্য যুগ তো বটেই। হরিয়ানাতেও ওমপ্রকাশ চৌটালার সঙ্গে সংস্রব রাখতে চায়নি অমিত শাহের দল। উল্টে চৌটালার দুর্নীতি সামনে এনে জোর প্রচার চালায় বিজেপি।
প্রশ্ন উঠেছে, কেন হঠাৎ একলা চলার সিদ্ধান্ত নিল বিজেপি? দলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। ফলে জোটরক্ষার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু এ বার লোকসভা ভোটে ২৮০-র বেশি আসন পাওয়ার পর নেতৃত্বের মনে হয়েছে, রাজ্যে-রাজ্যে দলের একক স্বাধীন বিকাশের জন্য ঝাঁপানোর এর চেয়ে ভাল সময় আর হতে পারে না।” বিজেপির বক্তব্য, নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন প্রায় পাঁচ মাস। এখনও মোদী হাওয়ার প্রভাব রয়েছে দেশে। তাই এই সময়ে বিভিন্ন বিধানসভা ভোটে ‘একলা চলো রে’ নীতিকেই অগ্রাধিকার বলে মনে করছেন দলীয় সভাপতি অমিত শাহ।
ঠিক যে কারণে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে কোনও নির্ভরশীলতাই রাখতে চাইছেন না অমিত। লোকসভা নির্বাচনের আগেও তৃণমূলের সঙ্গে কোনও জোট বাঁধার চেষ্টাই করেনি বিজেপি। সেই ভোটে দার্জিলিং আসনটি তো ধরে রাখা গিয়েইছে, উল্টে আসানসোলও ছিনিয়ে নিয়েছে বিজেপি। মমতার খাসতালুক কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রে ভোট বেড়েছে বিজেপির। খোদ মমতার বিধানসভা কেন্দ্র ভবানীপুরে এগিয়ে ছিলেন বিজেপি প্রার্থী তথাগত রায়। সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা আসনটি দখলে এসেছে বিজেপির। আসলে অমিত শাহের বক্তব্য স্পষ্ট, “পশ্চিমবঙ্গে শাসক দলের বিরোধিতা না করে বিরোধী দলের ভূমিকা বিজেপি পালন করবে কী করে? মমতা সরকারের ব্যর্থতা, দুর্নীতি এই সবই তো প্রচারের বিষয়।” বিজেপি সভাপতির ব্যাখ্যা, সিপিএমের সঙ্গে আঁতাঁত করে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস শেষ হয়ে গিয়েছে। কাজেই মমতার সঙ্গে আঁতাঁত করে বিজেপি আত্মঘাতী হবে কেন?
দলের মধ্যে লালকৃষ্ণ আডবাণী, রাজনাথ সিংহ এমনকী অরুণ জেটলির মতো নেতারাও ভাবছিলেন, রাজ্যসভায় যে হেতু এখনও বিজেপি সংখ্যালঘু, তাই মমতা সম্পর্কে একটু নরম মনোভাব নেওয়া ভাল। যেমন দরকার জয়ললিতা, মায়াবতী, নবীন পট্টনায়ক, এমনকী নীতীশ কুমারের জন্যও সম্ভাবনার দরজা খোলা রাখা। কিন্তু মোদী-অমিত শাহ এই তত্ত্বের পক্ষে নন। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্যসভায় বিল পাশে সমস্যা হলে প্রয়োজনে সংসদের যৌথ অধিবেশন ডেকে বিল পাশ করানো হবে। কিন্তু আঞ্চলিক নেতানেত্রীদের কাছে মাথা নোয়ানো হবে না। যে কারণে জয়ললিতা (যাঁর সঙ্গে মোদীর সুসম্পর্কের কথা সর্বজনবিদিত) জেলে গেলেও কোনও রকম রাজনৈতিক দুর্বলতা দেখায়নি বিজেপি। যে কারণে ওড়িশায় বিজু জনতা দলের সঙ্গে সংঘাতের পথ ধরে হাঁটছে তারা। বিহারে নীতীশ কুমারের সঙ্গেও এখনই গাঁটছড়া বাঁধা ভাবনায় নেই তাদের।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু মোদী হাওয়াকে ব্যবহার করাই নয়, রীতিমতো অঙ্ক কষে ঝুঁকিটা নিয়েছেন মোদী-অমিত। লোকসভা ভোটের পরে কয়েকটি রাজ্যে বিক্ষিপ্ত ভাবে কয়েকটি উপনির্বাচনে বিজেপির খারাপ ফল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাকে বিশেষ পাত্তা দিতে নারাজ বিজেপি নেতৃত্ব। তাঁদের বক্তব্য, এই ধরনের উপনির্বাচন হয় স্থানীয় বিষয়ের ভিত্তিতে। সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রতিফলন এই ভোটের ফলে দেখা যায় না। বরং মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানায় একলা চলে তাঁরা ভাল ফলের ব্যাপারে আশাবাদী।
২৫ বছর আগে যখন মহারাষ্ট্রে শিবসেনার সঙ্গে জোট বেঁধেছিল বিজেপি, তখন বাল ঠাকরে স্বমহিমায়। ‘জয় মহারাষ্ট্র’ স্লোগান তুলে তিনিই তখন মরাঠি ভোটব্যাঙ্কের প্রধান স্বত্ত্বাধিকারী। আর বিজেপির লক্ষ্য ছিল মূলত মহারাষ্ট্রে বসবাসকারী গুজরাতি সম্প্রদায় এবং মুম্বইয়ের মতো শহুরে অঞ্চলের মানুষেরা। এই জোট দু’পক্ষকেই রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছিল। মহারাষ্ট্রে ক্ষমতাও দখল করেছিল বিজেপি-শিবসেনা জোট। এখন ২৫ বছর পর শিবসেনার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে মহারাষ্ট্রের মানুষের কাছে প্রধান দল হয়ে উঠতে চাইছে বিজেপি। কংগ্রেস-এনসিপি জোটের বিরুদ্ধে যে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া রয়েছে, তাকে কাজে লাগাতে চাইছেন মোদী-অমিত। এবং চাইছেন পাঁচমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোট ভাগের সুবিধাকেও কাজে লাগাতে। সুকৌশলে বিজেপি বলেছে, দিল্লিতে আমরা আছি। রাজ্যেও আমাদের নিয়ে এলে মহারাষ্ট্রের উন্নয়ন সহজতর হবে। সহজ হবে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কও। আর সে জন্যই যে পৃথক বিদর্ভ রাজ্যের দাবিকে বিজেপি সমর্থন করেছে দীর্ঘদিন ধরে, তাকে পাশে সরিয়ে রেখে মোদী মুম্বইয়ে এসে বলে গিয়েছেন অখণ্ড মহারাষ্ট্রের কথা। বলেছেন, রাজ্য ভাগ হতে দেব না। বিজেপির অবস্থানগত এই পরিবর্তন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। একই সঙ্গে কৌশলের অঙ্গ হিসেবে ক্ষমতায় এলে বিদর্ভের সন্তানকেই মুখ্যমন্ত্রী করার কথা ভাবা হচ্ছে।
হরিয়ানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমপ্রকাশ চৌটালা এক সময়ে এনডিএ-তে ছিলেন। এ বারের ভোটে সেই চৌটালার সঙ্গে কোনও আপস না করে উল্টে তাঁর দুর্নীতি নিয়ে সরব হওয়ার ঝুঁকি নিয়েছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। সেই ঝুঁকি এতটাই যে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে চৌটালার দলের সঙ্গে তাঁদের নির্বাচন-উত্তর জোট বাঁধা মতাদর্শগত ভাবে বেশ কঠিন। ঠিক যে ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অল্প দূরে আটকে গিয়ে দিল্লিতে আজও সরকার গড়তে পারেনি বিজেপি। তা সত্ত্বেও এই ঝুঁকির পথে হাঁটাই এখন মনস্থ করেছেন মোদী-অমিত জুটি।
আর এই পথ-বদলে আগাগোড়া মোদী পাশে পাচ্ছেন সঙ্ঘকে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলেন, “এখন আমরা রাজ্যে-রাজ্যে আরএসএসের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সাংগঠনিক যোগাযোগ গড়ে তুলেছি। ১৯৮৯-৯০ সালে লালকৃষ্ণ আডবাণী রামমন্দির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিজেপি, আরএসএস এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো ধর্মীয় সংগঠনের মধ্যে একটা মেলবন্ধন গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক সংগঠনটির সঙ্গে বিজেপির দূরত্ব বাজপেয়ী জমানায় অনেক বেড়ে গিয়েছিল।” রাজনাথের ব্যাখ্যা, এক দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পর মোদী-অমিত শাহের নেতৃত্বে রাজ্যে-রাজ্যে অন্য রাজনৈতিক শরিক দল না থাকলে কী হবে, বিজেপির এখন সব থেকে বড় জোটসঙ্গী হয়ে উঠেছে সঙ্ঘ পরিবার।
রাত পোহালে রবিবার ভোটের ফল প্রকাশিত হবে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায়। মোদী-অমিত জুটির নয়া রণকৌশলের পরিণতি কী হয়, সেটাই দেখার।