এক দশকের আন্দোলনে যে কাজ হয়নি, ভোটের দিন বনধ ডেকে সেটাই আদায় করল মিজোরাম!
ত্রিপুরার শরণার্থী শিবিরের ব্রু বা রিয়াং শরণার্থীদের ‘পোস্টাল ব্যালটে’ ভোটদানের প্রতিবাদে গতকাল থেকে ৭২ ঘণ্টার বন্ধ ডেকেছিল রাজ্যের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চ। তার জেরে আগামীকাল মিজোরামে ভোট স্থগিত করে দেওয়া হল। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, সেখানে ভোট হবে ১১ এপ্রিল। শুধু তা-ই নয়, যৌথ মঞ্চের চাপে কমিশন মেনে নিল, আগামী নির্বাচনগুলিতে রিয়াং শরণার্থীদের মিজোরামে থেকেই ভোট দিতে হবে।
১৯৯৭ সালে গোষ্ঠী সংঘর্ষের জেরে ব্রু বা রিয়াং উপজাতির বাসিন্দারা মিজোরাম ছেড়ে ত্রিপুরায় পালিয়ে যান। তারপর থেকেই ত্রিপুরার ছ’টি শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী রিয়াং ভোটাররা পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিতেন।
ঘর-ছাড়া রিয়াংদের পোস্টাল ব্যালটে ভোটদানের অধিকার কেড়ে নেওয়ার দাবিতে, মিজোরামের সব রাজনৈতিক দল, ছাত্র এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি এক দশক ধরে আন্দোলন চালাচ্ছিল। কিন্তু, নির্বাচন কমিশনের তরফে সাড়া মেলেনি। মিজোরামের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিশ্বজিৎ দেব জানান, দু’মাস আগে বিষয়টি নিয়ে কমিশনের কাছে স্মারকলিপি জমা দেন মুখ্যমন্ত্রী লাল থানহাওলা। কমিশনের সঙ্গে মিজো প্রশাসনের আলোচনা চলাকালীনই লোকসভা ভোটের দিন ঘোষণা হয়ে যায়। কমিশন জানিয়েছিল, এ বারও ‘জন প্রতিনিধিত্ব আইনের’ ৬০ সি ধারার সুবিধা নিয়ে রিয়াংরা পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেবেন। নির্বাচনের পর মিজো সরকারের দাবির বিষয়ে পদক্ষেপ করা হবে।
১ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত রিয়াং ভোটাররা পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেন। এরপরই, মিজোরামে আন্দোলন আরও তীব্র হয়। গতকাল ভোর ৫টা থেকে সে রাজ্যের শক্তিশালী তিন সংগঠন এমজেডপি, মিজো ছাত্র সংগঠন ও এমইউপি ৭২ ঘণ্টার বনধ ডাকে। তারা জানায়, রিয়াংদের ভোট বাতিল করতে হবে। রাজ্যে লোকসভার একটি আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা তিন প্রার্থীকেও জানানো হয়, রিয়াংদের ভোট গণ্য করলে চলবে না। বন্ধের জেরে লাওংগতলাই ও সাইহা ছাড়া রাজ্যের অন্য কোনও জেলায় যেতে পারেননি ভোটকর্মীরা।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চের দাবি শেষ পর্যন্ত মেনে নেয় নির্বাচন কমিশন। মিজোরামে ভোট পিছিয়ে ১১ এপ্রিল করা হয়। নির্বাচন কমিশনের সচিব নরেন্দ্র এন ভুতোলিয়া, রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসারকে চিঠি পাঠিয়ে জানান, আগামী নির্বাচন থেকে রিয়াং ভোটারদের মিজোরামেই ভোট দিতে হবে।
যৌথ মঞ্চের দাবি, নির্বাচনের পর তিন মাসের মধ্যে ত্রিপুরার শিবির থেকে রিয়াং পরিবারগুলিকে রাজ্যে ফিরিয়ে আনতে হবে। যাঁরা ফিরতে রাজি হবেন না, তাঁদের নাম মিজোরামের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। এই নির্বাচনে পোস্টাল ব্যালটে দেওয়া রিয়াংদের ভোট বাতিল করারও দাবি ওঠে। রাজ্য নির্বাচন কমিশন সূত্রে খবর, ভোটের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর, রিয়াংরা নিয়ম মেনেই ভোট দিয়েছেন। তাঁদের ভোট বাতিল করতে হলে নতুন করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে। তাতে সমস্যা আরও জটিল হবে।
রাজ্য সরকারের বক্তব্য, অনেক দিন ধরেই ত্রিপুরার শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী রিয়াং উপজাতির মানুষকে ফিরে আসার আহ্বান জানানো হচ্ছে। কিন্তু, নিজেদের ইচ্ছায় এবং একটি গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাঁরা ফিরছেন না। গত নভেম্বর মাসে, রিয়াংদের একটি অংশ মিজোরামে ফিরে আসেন। তাঁরা বিধানসভা ভোটেও অংশ নেন। মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জানান, অন্য রিয়াং পরিবারগুলি রাজ্যে ফিরলে, নিরাপত্তা ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেবে সরকার।
রিয়াংদের বক্তব্য, তাঁদের পরিস্থিতি অনেকটা কাশ্মীরের পণ্ডিতদের মতো। বাধ্য হয়েই সকলকে ঘর-ছাড়া থাকতে হচ্ছে। তাঁদের পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার অধিকার যেন জারি থাকে। মিজোরামের অ্যাডভোকেট জেনারেল বলেন, “কাশ্মীরের পণ্ডিতদের সঙ্গে মিজোরাম এবং রিয়াংদের তুলনা চলে না। এখানে সব দল ও সংগঠন রিয়াংদের ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী। ওঁরাই ফিরতে চাইছেন না।”
পড়শি রাজ্যে বনধের জেরে সমস্যায় পড়েছেন ত্রিপুরার অনেকে। সীমানা পার হয়ে যানবাহন ঢুকতে পারছে না। উত্তেজনা ছড়াচ্ছে দু’রাজ্যের সীমানা সংলগ্ন এলাকায়। উত্তর ত্রিপুরার পুলিশ সুপার অভিজিৎ সপ্তর্ষি জানান, সীমানার কাছাকাছি এলাকায় আইন-শৃৃঙ্খলার দিকে নজর রাখা হয়েছে। রাজ্যের যুগ্ম মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক দেবাশিস মোদক জানান, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে রিয়াং শিবিরে আশ্রিত শরণার্থীদের পোস্টাল ব্যালটগুলি ত্রিপুরার ‘স্ট্রং-রুমে’ রাখা হয়েছে। ১৬ মে সেখানেই সে গুলি গণনা করা হবে।