দোষের তালিকা ছোট নয় মোটেই। একে তো নাক চ্যাপ্টা। গড়নও মূল ভূখণ্ডের মানুষের থেকে আলাদা। আর বাড়ি দেশের কোন এক কোণায় সেই উত্তর-পূর্বে।
তাই যেমন খুশি নামে ডাকা যায় এঁদের! ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সকলেই হয়ে যান নানা আপত্তিকর শব্দবন্ধ। খাস রাজধানী হোক বা মেট্রো শহর, অথবা ছোট কোনও শহরতলি সব জায়গাতেই ছবিটা এক। বোঁচা নাক আর ছোট চোখের দৌলতে কোথাও এঁরা চাইনিজ, কোথাও আবার মোমো। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের খাবার যে। একটা গোটা জাতির সত্তা কী অনায়াসেই না জুড়ে দেওয়া যায় খাবারদাবারের সঙ্গে!
কিন্তু সেখানেই তো শেষ নয়। অন্যদের থেকে আলাদা, শুধু এই কারণেই খুন, শারীরিক নিগ্রহ, শ্লীলতাহানির শিকার হতে হয় উত্তর-পূর্বের বহু তরুণ-তরুণীকে। গত ২৯ জানুুয়ারি, অরুণাচল প্রদেশের বাসিন্দা হওয়ার অপরাধে দিল্লির রাস্তায় নির্মম ভাবে পিটিয়ে খুন করা হয় ছাত্র নিদো তানিয়াকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তথ্যই বলছে, শুধু দিল্লি নয়, বেঙ্গালুরু, কলকাতা-সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তেই জাতিগত বিদ্বেষের শিকার উত্তর-পূর্বের মানুষ। ক্রমশ বেড়ে চলা এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অবশেষে পদক্ষেপ করল কেন্দ্র। উত্তর-পূর্বের মানুষের উপর হয়রানি রুখতে সম্প্রতি কেন্দ্রের কাছে একটি রিপোর্ট জমা দিয়েছেন প্রাক্তন আমলা এম পি বেজবরুয়া। নিদোর মৃত্যুর পর কঠোর আইন প্রণয়নের লক্ষ্যেই তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। শুক্রবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ জানালেন ওই রিপোর্টে করা সুপারিশ মেনে নেবে সরকার।
কী বলা হয়েছে ওই রিপোর্টে?
ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩ ধারায় আছে, কেউ ধর্ম, জাতি বা বর্ণের ভেদে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করলে সেটা অপরাধ। বেজবরুয়া কমিটি ১৫৩ ধারার সংশোধনের পক্ষে। ওই কমিটিকে উত্তর-পূর্বের বহু মানুষ জানিয়েছেন, দেশের অন্য প্রান্তের বাসিন্দারা অপমানজনক নামে ডাকেন তাঁদের।
বেজবরুয়া কমিটির দাবি, এ বার থেকে কোনও ব্যক্তির জাতি, সংস্কৃতি, পরিচয় বা শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আপত্তিকর কথা বললে অপরাধ হিসেবে দেখা হোক সেটাও। অর্থাৎ যে ভাষা ব্যবহার করলে কোনও ব্যক্তির আবেগে আঘাত লাগবে, তা শাস্তির আওতায় আনা হোক। আর তাই আইন সংশোধনের দাবি জানানো হয়েছে রিপোর্টে। কী ভাবে তা করা যায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে সেটা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছে ওই কমিটি। প্রয়োজনে ওই ধরনের অপমানজনক শব্দের একটি তালিকা সংশোধনী হিসাবে মূল আইনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার সুপারিশ করেছে বেজবরুয়া কমিটি।
জাতিগত বিদ্বেষ ছড়াতে পারে এমন শব্দের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি আইনরক্ষকদের মনোভাব বদলের কথা আছে ওই রিপোর্টে। উত্তর-পূর্বের মানুষের অভিযোগ, বেশিরভাগ সময়ই তাঁদের কথা সহানুভূতির সঙ্গে শোনে না দেশের মূল-ভূখণ্ডের পুলিশ। অভিযোগ না নিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের। কোথাও আবার, অভিযুক্তের হয়ে সওয়াল করে খোদ পুলিশই।
তাই এই রিপোর্টে বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশের সঙ্গে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির পুলিশের সমন্বয় গড়ে তোলার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। আজ রাজনাথ সিংহ বলেন, “দিল্লি পুলিশকে বলা হয়েছে উত্তর-পূর্বের প্রতিটি রাজ্য থেকে কুড়ি জনকে দিল্লি পুলিশে অর্ন্তভুক্ত করতে। আর দিল্লির অফিসাররা যাবেন ওই রাজ্যে।” একই সঙ্গে রাজনাথ জানিয়েছেন, আগামী দিনে উত্তর-পূর্বের মানুষ নিগ্রহের শিকার হলে তাঁদের ক্ষতিপূরণ আইন ২০১১ (দিল্লি)-এর আওতায় আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।