প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ-জয়ই সাহসী করেছে কাশ্মীরকে

সারা দেশের ক্রিকেটারেরা যখন ঘরোয়া মরসুমের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, তখন তাঁরা অনেকেই আত্মীয়, বন্ধুদের অন্ত্যেষ্টিতে চোখের জল ফেলছিলেন। অন্য রাজ্যের ক্রিকেটারেরা যখন আমন্ত্রণী টুর্নামেন্টে খেলে নিজেদের তৈরি করছিলেন, তখন তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন বন্যায় বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি মেরামতিতে।

Advertisement

রাজীব ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:২২
Share:

কাশ্মীরের এক ক্রিকেটারের পাশে সচিন তেন্ডুলকর। ছবি: পিটিআই।

সারা দেশের ক্রিকেটারেরা যখন ঘরোয়া মরসুমের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, তখন তাঁরা অনেকেই আত্মীয়, বন্ধুদের অন্ত্যেষ্টিতে চোখের জল ফেলছিলেন।

Advertisement

অন্য রাজ্যের ক্রিকেটারেরা যখন আমন্ত্রণী টুর্নামেন্টে খেলে নিজেদের তৈরি করছিলেন, তখন তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন বন্যায় বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি মেরামতিতে।

প্রকৃতির এই প্রবল রোষ সামলে যাঁরা যুদ্ধ জিততে পারেন, বাইশ গজের লড়াইটা তাঁদের কাছে আর বড় কী! ৪০ বারের রঞ্জি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন মুম্বইকে তাদের দুর্গ ওয়াংখেড়েতে হারানোর মধ্যে বারবার যেন সেই বার্তাটাই ফুটে উঠেছে। ক্রিকেট কৌলিন্য তো বটেই, ধারে-ভারে কোনও ভবেই মুম্বই টিমের কাছে একশো ফুটের মধ্যে নেই এই দলটা। তবু ডেভিড ও গালিয়াথের প্রবাদ ফিরিয়ে আনলেন তাঁরা অদম্য জেদে। প্রমাণ করলেন, বাইশ গজে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার সময় একজোট জম্মু এবং কাশ্মীর।

Advertisement

বৃহস্পতিবার কোয়ম্বত্তূর থেকে ডিন্ডিগুল যাওয়ার পথে দলের অধিনায়ক পারভেজ রসুল বললেন, “যে দুঃসময় পেরিয়ে উঠে আসতে হয়েছে আমাদের, তা ভাবলে এখনও কেঁপে উঠি। চার দিকে যখন জল থই থই। তখন মনে হতো, এই বছর মাঠে ফিরতে পারব তো? আল্লাহ্ সহায় হয়েছেন বলেই পেরেছি।” ফোনে তিনি জানালেন, “বন্যার জল নামার পর যে যেখানে পেরেছি ব্যাট-বল নিয়ে নেমে পড়েছি।”

বিজবেহরার বাড়ির দোতলা থেকে ঝাঁপ মেরে পারভেজের নিজের ক্রিকেট সরঞ্জাম বাঁচানোর ঘটনা সংবাদমাধ্যমের দৌলতে এখন প্রায় সকলেরই জানা। আর এক জনেরও তেমনই অভিজ্ঞতা। যিনি মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে দুই ইনিংসে ১০৭ ও ৭৮ করেন ওয়াংখেড়েতে, সেই শুভম খাজুরিয়া। জম্মুর ছেলে হলেও বন্যার সময় ছিলেন শ্রীনগরে। আটকে ছিলেন এক হোটেলের দোতলায়। এ দিন কোয়ম্বত্তূর থেকে শুভম বললেন, “এক সপ্তাহ ঠিকমতো খাবার পাইনি। ক্রিকেট গিয়ারগুলোও ভেসে যেতে বসেছিল। কোনও রকমে বাঁচাই।” অক্টোবরে দেশের মাঠে চার দলীয় ওয়ান ডে টুর্নামেন্টে অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলেও সুযোগ পান শুভম। “ওই টুর্নামেন্টকে ধন্যবাদ। বন্যার ধ্বংসস্তূপ থেকে দূরে সরে গিয়ে ক্রিকেটে মন দিতে পারলাম ওই টুর্নামেন্টের জন্যই।”

আর আছেন ইয়ানদেব সিংহ। বন্যার সময় জম্মুতে এক স্থানীয় লিগ খেলতে গিয়ে সতীর্থদের সঙ্গে এক পাহাড়ের উপর আস্তানা গেড়ে দশ দিন বসেছিলেন, অভুক্ত। বললেন, “তখন আর এখনে কত ফারাক! তখন আমরা ছিলাম বিশ্বের সবচেয়ে বিপন্ন মানুষগুলোর এক জন। এখন সবচেয়ে সুখী আমরাই। কাশ্মীর থেকে প্রচুর ফোন পেয়েছি। সবাই খুব খুশি।”

বন্যার ধ্বংসলীলা থেকে এখন মাথা তুলে বেঁচে থাকার লড়াই শুরু হয়েছে জম্মু-কাশ্মীরে। তার মধ্যে এই জয়ের খবর তাঁদের কাজের অক্সিজেন জোগাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায় কোহলিদের পারফরম্যান্সের চেয়েও কাশ্মীরবাসীদের মুখে এখন বেশি করে পারভেজদের কথা। পারভেজ ভারতীয় দলে ঢুকে পড়ার পর থেকে রাজ্যের ক্রিকেটারদের জনপ্রিয়তাও ক্রমেই বাড়ছে। এই জয়ের পরে সেই জনপ্রিয়তা অন্য মাত্রা পাবে বলে মনে করছেন জম্মু-কাশ্মীর ক্রিকেট সংস্থার প্রধান ওমর আবদুল্লা। তাঁর বক্তব্য, “কাশ্মীরেও যে ক্রিকেট প্রতিভা আছে, তা নিয়ে আর সন্দেহ রইল না।” ফারুক আবদুল্লাও উচ্ছ্বসিত তাঁদের এই জয়ে।

কিন্তু কী করে সম্ভব হল এই রূপকথা?

রসুলের ব্যাখ্যা, “প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে জেতার আত্মবিশ্বাসটাই কাজে লেগেছে। আমরা জানতাম, বন্যায় বিধ্বস্ত হওয়ার পরও যখন ক্রিকেট মাঠে ফিরতে পেরেছি, তখন ওয়াংখেড়েতে দাঁড়িয়ে মুম্বইকে হারাতেও পারি। আমাদের প্রাক্তন কোচ বিষেন সিংহ বেদীও বারবার বলেছেন, ক্রিকেটে ছোট-বড় কিছু হয় না। জান লড়িয়ে দিতে পারলে দিল্লি, মুম্বই কেউ বড় টিম নয়।”

মরসুম শুরুর আগে নাগপুরে সপ্তাহ দুয়েকের প্রস্তুতি শিবির করার সুযোগ পেয়েছিলেন পারভেজরা। জয়ের শপথ নেওয়া শুরু সেখানেই। একাত্মবোধটা তৈরি হয় সেখানে, বলছিলেন রসুল। তিনি বিশ্বকাপের সম্ভাব্য ৩০-এর মধ্যেও আছেন।

আগের দিন ওয়াংখেড়েতে থেকেও তাঁদের সঙ্গে দেখা না করে চলে গিয়েছিলেন সচিন তেন্ডুলকর। বৃহস্পতিবার সকালে পারভেজদের সেই আক্ষেপ মিটিয়ে দিলেন তিনি। ঘণ্টাখানেক তাঁদের সঙ্গে সময় কাটালেন তিনি। কেমন সেই অভিজ্ঞতা? শুভম বললেন, “ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল উনি আমার পাশে বসে গল্প করছেন।” কী বলে গিয়েছেন সচিন?

শোনা গেল, অভিনন্দনের সঙ্গে সতর্কও করে দিয়েছেন মাস্টার ব্লাস্টার: “এমন সাফল্য এলেও উৎসবের আতিশয্যে ভেসে যেও না।”

সহ-প্রতিবেদন: সাবির ইবন ইউসুফ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement