প্রতিটি উত্সব পালনের একটা নিজস্ব প্রথা আছে। হয়তো দিনকালের নিরিখে তা বদলেও যায়। আজকের দিনে শিক্ষিত মানুষ তার পারিপার্শ্বিকের অনেক অনেক কিছু জেনে ফেলে নিমেষেই। কিন্তু এই অনেক কিছু জেনে ফেলেও নিজের থেকে ক্রমশ দূরে, আরও দূরেই সরে গেছে। যে হয়তো বাইরের পৃথিবীকে আপন করেছে, কাছেও টেনেছে, অথচ নির্মম ভাবে নিজের মধ্যে যে পৃথিবীটুকু ছিল তা থেকে হারিয়ে যেতে যেতে দুস্তর ব্যবধানের ছোট্ট ছোট্ট দ্বীপের মতো একাকী হয়ে উঠেছে অনবধানে। এখন তো যোজন দূরের বার্তা সে শুনতে পায় নিজের ইচ্ছেমতন চাবি টিপে।
এই যেমন সে দিন আমার মোবাইল স্ক্রিনে ‘হোয়াটসঅ্যাপে’ ফুটে উঠল আগাম এক শুভেচ্ছা বার্তা‘সেলিব্রেট দিজ বেঙ্গলি নিউ ইয়ার উইথ মাছ, মিষ্টি অ্যান্ড পায়েস... হ্যাপি নববর্ষ ১৪২১ ইন অ্যাডভ্যান্স’। একই বার্তা তারপর ফরোয়ার্ড মেসেজ হিসেবে পেলাম পরের দিনও। কোনও মানে হয়? বহির্বঙ্গে আছি বলেই কি পইপই করে স্মরণ করিয়ে দেওয়া বং কানেকশনস শিকড়ের কথা।
বত্সরাম্ভরের প্রথম দিনটা নিয়ে হুজুগে মেতে থাকা আর কী! আহা, বছরে তো ওই একটা দিনই বাঙালি আভিজাত্য নিয়ে কাটানো। হোক না বহির্বঙ্গ, বাঙালিত্ব চাগাড় দিয়ে ওঠে। সাতসকালে টেলিভিশন খুলে ‘নববর্ষের প্রভাতী বৈঠক’। তারপর একটু সকাল গড়ালেই ফোনে নববর্ষের প্রণাম জ্ঞাপন। আত্মীয়কুলের দুই তরফেই মামাবাড়ি, জ্যাঠার বাড়ি, পিসির বাড়ি, তুতো ভাশুরদের বাড়ি সমস্ত সিনিয়রদের ফোনে ফোনেই প্রণাম ও শুভেচ্ছা আদান-প্রদান চলতেই থাকে। প্রবাসে থাকি তো! তাই ঘরের জন্য মনকেমন করা বেদনাটা কিঞ্চিত্ বেশিই থাকে।
ও দিকে এর মধ্যেই পরিপাটি করে ঘর গোছানো সদ্য কেনা নতুন বিছানার চাদর, বালিশের কভার, কুশন কভারে। সে দিন মিউজিক সিস্টেমে শুধুই লোকগান ও রবীন্দ্রসঙ্গীত। আরে বাবা! রবিঠাকুর কি কারও একার? কবি তো বিশ্বজনীন। নতুন বছরের প্রথম দিনটি নিদেন পক্ষে বাড়িতে অন্য রকম রান্না, খাওয়াদাওয়া অর্থাত্ টিপিক্যাল বেঙ্গলি খানা। ওই শুক্তো, কুচো চিংড়ি দিয়ে মোচার ঘণ্ট, নারকেল দিয়ে সোনামুগ ডাল, ধোঁকার ডালনা, দইমাছ, কাঁচা আমের চাটনি। রোববার সকালে লুচি-আলুচচ্চড়ি, কালোজিরে-কাঁচালংকা ফোড়ন দিয়ে, অনেক বাড়িতেই হয়। ওই দিন না হয় বাড়িতেই কয়েকখানা হিঙের কচুরি বানিয়ে নেব, আর কিশমিশ-নারকোল দিয়ে মিষ্টি ঘন ছোলার ডাল। একটাই তো দিন, বাঙালিয়ানায় বর্তে থাকা।
এতটা লেখার পরই মনে হল, বাংলায় প্রচলিত নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ থেকে বঙ্গাব্দ উত্পত্তির সূচনা কবে থেকে হল, বঙ্গাব্দের উত্পত্তিই বা হল কী ভাবে! বিস্তর বিতর্ক থাকলেও ঐতিহাসিক মতে সব থেকে গ্রহণযোগ্য মত হল, মোগল সম্রাট আকবরের শাসনকালেই এর সূচনা হয়। অন্য মতে, গৌড়বঙ্গের রাজা শশাঙ্কের রাজত্বকালে বঙ্গাব্দের উত্পত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে দেখা যায়, কর্ণসুবর্ণ-র সিংহাসনে শশাঙ্ক আরোহণ করেন ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দে। সেই রাজ্যাভিষেকের বছর থেকেই অব্দ বা বত্সর গণনা করা হয়, তাই বঙ্গাব্দ। তবে এই ধারণার পক্ষে জোরালো কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। শশাঙ্কের সময়ে বা পরবর্তী কোনও লিপিতেও কিন্তু এমন কোনও অব্দের উল্লেখ নেই। অতএব দেখা গেছে, আকবরের রাজত্বের আগে পর্যন্ত বঙ্গাব্দ ব্যবহারের সঠিক প্রমাণাদি নেই। মোগল সম্রাট আকবর প্রবর্তিত ‘তারিখ ইলাহি’ বা ‘আকবরি ফসলি সন’ বঙ্গাব্দের উত্স হিসাবে বিজ্ঞানসম্মত সর্বজনগ্রাহ্য মতবাদ রূপে মেনে নেওয়া যেতে পারে। এটি আকবরের আমলে ‘চান্দ্র হিজরি’ অব্দের সংস্কারের মধ্যেই বঙ্গাব্দের সূচনার প্রয়াসটির ইঙ্গিত দেয়।
মোগল শাসনকালে মূলত হিজরি সন আর চান্দ্র ক্যালেন্ডারের প্রয়োগ হত। ভারতের মতো মৌসুমি বায়ুপ্রধান অঞ্চলে শস্যরোপণ, চাষাবাদ, ফসল তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল রাজস্ব আদায়। ভারতের মতো দেশে শাসনকার্য, রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত দিনক্ষণ ইসলামি ক্যালেন্ডার মেনে ঠিকমতো করা সম্ভবপর হচ্ছিল না, সৌরবর্ষ নিয়ন্ত্রিত ঋতুনিষ্ঠ ভারতীয় ক্যালেন্ডারের জন্য। আকবর তখন ১০৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ইরান দেশের ‘তারিখ ই জালালি’ বলে যে সৌর ছিল, এবং সে সময়ের জ্যোতির্বিদ আমির ফতেউল্লাহ মিরজির তত্ত্বাবধানে চান্দ্র ও সৌরবর্ষের সংমিশ্রণে ‘তারিখ ইলাহি’ নামে নতুন এক অব্দের প্রচলন করেন। সেটিই পরবর্তীতে বাংলায় বঙ্গাব্দ রূপে চালু হয়। আকবরের এই ‘তারিখ ইলাহি’র প্রবর্তনকাল ছিল ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ২১ মার্চ, যে দিন দিন ও রাত সমান হয় বলে মহাবিষুব দিনও বলা হয়। আরও কিছু কাল পরে সূর্যসিদ্ধান্ত মতে সৌর-বৈশাখ তথা মেষরাশিতে সূর্যের সংক্রমণের পরের দিবসকে অর্থাত্ মোটামুটি ১৫ এপ্রিল বর্ষারম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হত। জ্যোতির্বিজ্ঞানে আবার সায়ন-সৌরবর্ষ একক ও নিরায়ণ সৌরবর্ষ একক। এসব দিনক্ষণে নানান রীতি আছে। যেহেতু মধ্য এপ্রিল বাংলায় তথা ভারতবর্ষেও ফসল তোলার সময়, তাই একটি ‘মিশ্র অব্দ’ বা ‘সংকর বর্ষ’ হিসাবে একটু মেলবন্ধন করে নববর্ষ দিনটাকে সূচিত করা হয়।
আমাদের সাধারণ মগজে এত তথ্য ও তত্ত্বতলাশ কেমন ঘেঁটে যায়। তবে আমরা শৈশব থেকে শিখে নিই ইংরাজি বর্ষপঞ্জির মতোই বাংলাতেও বারো মাস। সেগুলো নক্ষত্রের নামানুসারে এসেছে। যেমন বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা নক্ষত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাড়া নক্ষত্র থেকে আষাঢ়, শ্রবনা নক্ষত্র থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, অশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, মৃগশিরা থেকে অগ্রহায়ণ, পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা নক্ষত্র থেকে চৈত্র। পঞ্জিকা মতে সাতটি বার-এর নামকরণ হয়েছে সৌরমণ্ডলের বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহের নামানুসারে।
প্রাচীন ইতিহাসে আরও একটু চোখ বুলিয়ে নিলে দেখতে পাব, বরাহমিহির ৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে পঞ্চসিদ্ধিকা নামে যে প্রামাণ্য গ্রন্থটি জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধে রচনা করেন তারই প্রথম হল ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’। সেই সূর্যসিদ্ধান্ত অনুসারে আকাশলোকে বিশাখা নক্ষত্র অনুসারে বৈশাখই বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস হিসেবে পয়লা বৈশাখই নববর্ষের দিন ধরা হয়। তবে বঙ্গাব্দের উত্পত্তি বিষয়ক এত সব জটিল মতবাদ থাকলেও, ঋতু পরিবর্তন ও কৃষিকার্যকে কেন্দ্র করেই বাংলা নববর্ষের সূচনা করা হয় বলেই সাধারণ বিশ্বাস।
চৈত্র সংক্রান্তি ও নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে পূর্ণ বসুন্ধরাকে আবাহন জানিয়ে ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে পালন করা হয় দেশজ ‘আর্তব উত্সব’। নববর্ষ দিনটি ঋতুধর্মী উত্সব হিসাবে প্রচলিত। বাংলা-ইংরাজি মিলিয়ে এ ভাবে এক একটা বছর আসে, যায়। আমরা আবার মনে মনে প্রার্থনা সাজাই। গোপন বাসনায় গেঁথে রাখি গূঢ় চাওয়াপাওয়াগুলি। নববর্ষের প্রাক্কালে আমরা ঐকান্তিক ভাবে লুকিয়ে রাখতে চাই অপ্রিয় দুঃখগুলি। পারদে তাপপ্রবাহের প্রতাপ ঊর্ধ্বমুখী। রাস্তায় বের হলে জ্বালা ধরাচ্ছে সর্বাঙ্গে। তারই মধ্যে আমরা গোছাতে থাকি আমাদের আগামী ভবিতব্য। আমাদের লালিত ইচ্ছেগুলোকে এই গরমেও একবার উল্টেপাল্টে নিই। ধরেই নিই সবই ঠুনকো অভিলাষ। তবু যেন এই নিরন্তর চাওয়া-পাওয়া, কামনা-বাসনা, আশা-নিরাশার ফাঁকে ফাঁকেই গুঁজে দিই সুখের স্বপ্ন দেখা। একঘেয়ে গতানুগতিক জীবনের কাছে রগড়ানি খাওয়া মাথায় রেখেও একটু সুখী-সুখী ভাল থাকতে চাওয়ার অভিলাষ। বৈশাখ এলেই তাই রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি মনে মনে গুনগুন করি, ‘মুছে যাক গ্লানি মুছে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’
সেই যে কবি বৈশাখের আবাহনে উচ্চারণ করেছিলেন ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গ্রীষ্মের দাবদাহ নিয়ে বৈশাখের আগমন মানেই ‘জীর্ণ পুরাতন’ গোটা পুরনো একটা বছর শেষ করে আর একটি বছরে প্রবেশ। বাঙালির কাছে বৈশাখের অর্থই নতুনকে বরণ করে নেওয়া। ব্যবসায়ী ও দোকানিরা ব্যস্ত থাকেন নতুন খাতা খোলার উদ্বোধনে। ভোর হতেই স্নান সেরে নতুন বস্ত্র পরিধান করে শুদ্ধ চিত্তে লক্ষ্মী ও গণেশের পূজার্চনা করা হয়। সঙ্গে অন্য আরাধ্যা দেবদেবীদেরও। অনেকে পুজোর ডালা নিয়ে কাছে-দূরের কোনও জাগ্রত মন্দিরে যান। সঙ্গে থাকে লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তি, হলুদ ও সিঁদুর মাখা মুদ্রা বা ষোলো আনা সেটিকে দেবী অঙ্গে স্পর্শ ও পুজো করিয়ে লাল শালুর বাঁধানো হিসাবের খাতায় দেবীর স্পর্শমাখা সিঁদুর লেপা মুদ্রার প্রণামী ছাপ দেওয়া হয় নতুন হালখাতার প্রথম পৃষ্ঠায়। ‘ওঁ শ্রী গণেশায় নমঃ’ কিংবা ‘শুভলাভ’ ও স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা এই হিসেবের খাতাটাই নতুন বছরের আয় ও সমৃদ্ধির প্রতিভূ। ফুল, আলো, কলাগাছ, আম্রপল্লব দেওয়া মঙ্গল ঘট দিয়ে সাজানো দোকানগুলোয় পরিচিত ও বাঁধা খদ্দেরদের জন্য মিষ্টিমুখের আয়োজন। সঙ্গে ঠান্ডা পানীয় ও ছোটখাটো উপহার। অনেক ব্যবসায়ী আবার অক্ষয় তৃতীয়ার দিনও এই অনুষ্ঠানটি পালন করে থাকেন। আসলে এই শাশ্বত ও সৌভ্রাতৃত্ব সুলভ রেওয়াজটি ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে এক সুন্দর মেলবন্ধন ঘটিয়ে দেয়। উত্সব অনুষ্ঠানের মানেও তো তাই। কোনও একটা বিষয় উপলক্ষ করে সবার সঙ্গে প্রাণের মিলন। ঘটা করে নববর্ষের দিন হালখাতা পালনও একটা উত্সব বিশেষ।
এখন উত্সবের ধরনেও এসেছে বিপুল পরিবর্তন। তবু নববর্ষ তথা নতুন বছরের সূচনায় হালখাতা আর গোলাপি নতুন বাংলা পঞ্জিকার গন্ধ এখনও পাওয়া যায় বইকী! আজ বাঙালি যতই আধুনিক বলে দাবি করুক, ঐতিহ্য পরম্পরা আজও তাদের পুরোপুরি ছেড়ে যায়নি। আগে সাবেক বাঙালি ঘরে নববর্ষের দিন দুধ উথলাবার একটি প্রাচীন প্রথা ছিল। গ্রামবাংলায় মূলত গোয়ালঘরেই এই পুজো করার রীতি ছিল। গোয়ালঘর পরিষ্কার করে সেখানে ছোট উনুন বানিয়ে মাটির মালসায় দুধ, মুঠোখানেক আতপ চাল ও গুড়-বাতাসা দিয়ে, পাটকাঠির জ্বালানি দিয়ে দুধ ফুটিয়ে পায়েস বানানো হত। সেই পায়েসের কিছুটা উনুনের মাটিতে রেখে, বাকি পায়েস পরিবারের সবাইকে বণ্টন করা হত। এই ছিল নববর্ষের দিন ‘দুধ উথলানো ব্রত’। আবার গ্রামবাংলায় কোনও প্রাচীন বটগাছের নীচে জলসত্র খোলা হয় তৃষ্ণার্ত পথযাত্রীর জন্য। কোথাও কোথাও সন্ধেবেলায় সেখানে রামায়ণ পাঠও হতে দেখা যেত। এখনও শহরের রাস্তায় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের খরার সময়ে জলসত্র দেখা যায়। অনেক মন্দিরেও দেখা যায় মাটির কলসির নীচে ফুটো করে বিগ্রহের শরীরে টুপটাপ করে জল ছিটোনোর প্রথা।
পুজোপার্বণের অন্যতম পয়লা বৈশাখ বাঙালি মহলে অন্য তাত্পর্য বহন করে। নতুনত্বের আশ্বাস নিয়ে নতুন পোশাকে নতুন রঙে একটা আলাদা আবেশে অন্য মাত্রায় কাটানোর দিন নববর্ষ। বাঙালির নববর্ষ পালনের সূচনার কথা শোনা যায় এক সময়ের যশস্বী কবি ও সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের হাত ধরে। তিনি এমনই এক নববর্ষের দিন অতিথি আপ্যায়ন করে বিশাল খানাপিনার আয়োজন করেন। শহর কলকাতার তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন সেই মজলিশি বৈঠকে। ঋষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও উপস্থিত ছিলেন। তার পর থেকেই বিশ শতকের গোড়ায় নিয়ম করে নববর্ষের দিন নাচগানের মজলিশ বসত বলে শোনা যায়। নকশাদার জাজিমে তাকিয়ায় ঠেসান দিয়ে বাবুদের সে আসরে থাকত আতর-সুরা-সারেঙ্গি-তবলা-হারমোনিয়াম-বাঈজির নাচগান।
গত শতকেও নববর্ষের সন্ধ্যাতে বা সামান্য রাতে পাড়ার মাচা জলসায় অমুক-কণ্ঠী তমুক-কণ্ঠীদের গানের বেশ রেওয়াজ ছিল। বেতার ও টিভির নামী শিল্পীদের বায়না করে নিয়ে আসা হত। এই সব অনুষ্ঠানও এখন কমে গেছে। নববর্ষের সকালে ইদানীং দূরদর্শনের প্রতিটি চ্যানেলেই একঘেয়ে বৈঠকী আড্ডা। নানা চ্যানেলে শিল্পী-কলাকুশলীদের কেতাদুরস্ত সাজগোজে গালগল্প। সন্ধ্যায় কালচারাল অডিটোরিয়ামগুলোয় বিচিত্রানুষ্ঠান। রেস্তোরাঁগুলো যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে বাঙালি খাবারের ঢালাও আয়োজনের। কত রকমের সনাতনী বাঙালি ব্যঞ্জন।
মরাঠা মুলুকে রয়েছি, এখানকার এক বিরল ব্যক্তিত্ব ড. ভীমরাজ রামজি অম্বেডকর। এই মরাঠি তথা ভারতীয় রাষ্ট্রবিপ্লবীর জন্মদিবস ১৮৯১ সালের ১৪ এপ্রিল। জনমানসে তিনি ‘বাবাসাহেব’ নামেই পরিচিত। সারা জীবন তিনি সামাজিক বৈষম্য ও অস্পৃশ্যতার বিরোধিতা করে গেছিলেন। তিনি এক সময়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হন। ১৯৯০ সালে তাঁকে মরণোত্তর ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত করা হয়। এছাড়া তিনি ‘আধুনিক বুদ্ধ’ বা ‘বোধিসত্ত্ব’ উপাধিতেও ভূষিত হন। তিনি দলিত বৌদ্ধ আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন। মরাঠা সম্প্রদায়ের গর্ব বাবাসাহেব ছিলেন একাধারে বাগ্মী, অর্থনীতিবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, পণ্ডিত, ঐতিহাসিক। সর্বোপরি ভারতীয় সংবিধানের মুখ্য প্রণেতা। মুম্বইয়ের রাস্তার মোড়ে বাবাসাহেবের বিশাল বিশাল কাটআউট। তাতে মালা পরানো। গান, বক্তৃতা সবই চলে তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
কাঠফাটা রোদ চিটচিটে গরম সহজেই মানুষকে কাবু করে। গরমকালকে কি আর শরীর-মন ফুরফুরে করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া অতই সহজ? এ দিকে এ সময়টা কলকাতার গড়িয়াহাট, হাতিবাগান অঞ্চলের বিখ্যাত চৈত্র সেল। যেখানে কখনও ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান’, কখনও ‘বাই এনি টু গেট অ্যানাদার ওয়ান ইন সেম প্রাইস। বা ফ্ল্যাট ১৫ থেকে ৪০ পার্সেন্ট ছাড়। চৈত্র বাজার সরগরম। গরমের এই নাজেহাল অবস্থায়ই আসে নতুন বছর। আটপৌরে বাঙালি নিজেদের ভুলে থাকা ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে নিজেদের মতো উপভোগ করে একবার ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন মাত্র। প্রচণ্ড গরমেও নতুন বছরের নতুন দিনটি সামনে এসে দাঁড়াবে নতুন বছরের আলোর প্রতীক্ষায় আবারও একবার। মুম্বইয়ের আনন্দবাজার পত্রিকার সুধী পাঠকদের জানাই প্রতিবেদকের হার্দিক শুভকামনা। শুভ নববর্ষ ১৪২১।