নেতৃত্বের মুখ বদল নিয়ে আলোচনা আপাতত শিকেয় তোলা থাকছে। প্রকাশ কারাট-বিমান বসুরা আগে লোকসভা নির্বাচনে হারের ময়নাতদন্ত সেরে নিতে চাইছেন। সেখানেও সেই পুরনো কায়দায় ‘কিছু তোমার ভুল, কিছু আমার ভুল’-এর কৌশলই নিচ্ছে সিপিএমের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্ব।
আজ থেকে দু’দিনের সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক শুরু হয়েছে। আলোচনার জন্য সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট যে খসড়া রিপোর্ট পেশ করেছেন, তাতে যেমন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভুল স্বীকার করা হয়েছে, তেমনই পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য নেতৃত্বের গাফিলতির কথাও বলা হয়েছে। নিজেদের মধ্যে দায় ভাগাভাগি করেই আপাতত নেতৃত্বের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখতে চাইছেন কারাট-বিমানরা। ঠিক হয়েছে, অগস্ট মাসে ফের পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ডাকা হবে। সেখানেই নেতৃত্বের মুখ বদল নিয়ে আলোচনা হবে। কী ভাবে সিপিএমের সব স্তরে নেতৃত্বে কম বয়সি মুখ তুলে আনা যায়, কী ভাবে নেতৃত্বে মহিলা, দলিত, আদিবাসীর মতো সব শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো যায়, তা নিয়ে আলোচনা হবে। সেই অনুযায়ীই আগামী বছরের পার্টি কংগ্রেসের সম্মেলন পর্ব শুরু হবে।
লোকসভা নির্বাচনের পর্যালোচনায় পলিটব্যুরোর রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, গত লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের থেকে মুখ ফিরিয়ে অনেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে চলে গিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই এখন
তৃণমূলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। কিন্তু তাঁরা তৃণমূলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও সেই ভোট বামেদের ঝুলিতে ফিরিয়ে আনা যায়নি। বিজেপি তাতে ভাগ বসিয়েছে। তারা নিজেদের বিকল্প হিসেবে তুলে ধরেছে। সেখানেই বামেদের ব্যর্থতা।
একই ভাবে জাতীয় স্তরেও বামেরা অ-কংগ্রেসি, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিকে একজোট করে তৃতীয় বিকল্প খাড়া করার চেষ্টা করেছিলেন। বলা হয়েছিল, লোকসভা নির্বাচনের আগে কোনও জোট না হলেও ভোটের পরে এই দলগুলি একজোট হয়ে বিকল্প সরকার গঠনের চেষ্টা করতে পারে। পলিটব্যুরোর খসড়া রিপোর্টে বলা হয়েছে, মানুষ এই সম্ভাবনাকে কোনও রকম গুরুত্বই দেয়নি। প্রকাশ কারাট, নীতীশ কুমার, মুলায়ম সিংহরা মিলে এক হয়ে স্থায়ী সরকার তৈরি করতে পারে, তা মানুষ বিশ্বাস করেনি। তবে এ ছাড়া যে আর কিছু করার ছিল না, তা-ও বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের যুক্তি, কোঝিকোড় পার্টি কংগ্রেসেই ঠিক হয়েছিল বিজেপি ও কংগ্রেসের থেকে সমান দূরত্ব রেখে ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সঙ্গে কাজ করবে বামেরা। সেই অনুযায়ীই বামেরা নিজেদের সাধ্য মতো চেষ্টা করেছেন।
পলিটব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গেও কে বিজেপি প্রার্থী, তা না দেখে নরেন্দ্র মোদীর সরকার গঠনের লক্ষ্যে মানুষ ভোট দিয়েছে। পাশাপশি তৃণমূলের বুথ দখল-রিগিংয়ের ফলেও বামেদের সঙ্গে ভোটের ব্যবধান বেড়ে গিয়েছে। তৃণমূল যেখানে পেয়েছে ৩৯.৩ শতাংশ ভোট, সেখানে বামেরা পেয়েছে ২৯.৫ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ দুই শিবিরের মধ্যে ভোটের ব্যবধান প্রায় ১০ শতাংশ। রিগিং না হলে এবং মোদী-ঝড় না থাকলে বাম ও তৃণমূলের মধ্যে ভোটের ব্যবধান অনেকটাই কমে আসত বলে রাজ্য নেতাদের দাবি। এই ভরাডুবির ভিতরেও যদিও রাজ্যের অনেক নেতার আশা, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মোদী ঝড় থাকবে না। তখন মানুষ তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে বামেদেরই বেছে নিতে পারে। বিজেপি পাঁচ বছর আগের লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় ভোটের ভাগ ৬.১৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে এ বার লোকসভায় ১৬ শতাংশের উপরে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এর অনেকটাই বিজেপির নিজস্ব ভোট নয়। আগামী বিধানসভায় এই ভোটের অনেকটাই বামেদের ঝুলিতে চলে আসতে পারে।
কিন্তু এ বারের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে যে ভাবে ভোটের মেরুকরণ হয়েছে, তা নিয়েই সব থেকে বেশি চিন্তায় পড়েছেন সিপিএম নেতারা। তাঁদের মতে, নরেন্দ্র মোদী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবাদে ধর্মীয় লাইনে ভোটের মেরুকরণ হয়েছে। আর বামেদের দুর্বলতার ফলেই এই মেরুকরণ হয়েছে।