অবশেষে বোধোদয় হল সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্বের! আর্থিক উদারনীতির বিরোধিতা করেই যে তাঁদের এই অবক্ষয়, শেষ পর্যন্ত সে কথা মেনে নিলেন তাঁরা।
‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ কিংবা ‘পুঁজিবাদ নিপাত যাক’ মান্ধাতা আমলের এই সব স্লোগানে আর কাজ হচ্ছে না। ‘নভেম্বর বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’ বলে গলা ফাটালেও তরুণ প্রজন্মের হেলদোল নেই। উল্টে সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে কাজে যাওয়ার সময় পথ অবরোধে লাল ঝান্ডা দেখলে বিরক্তই লাগে অনেকের। দেরিতে হলেও এই সত্যটা অবশেষে স্বীকার করে নিলেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। অর্থনৈতিক উদারীকরণের দু’দশক কেটে যাওয়ার পরে আজ দলকে সময়োপযোগী করে তোলার ডাক দিলেন তিনি। একের পর এক নির্বাচনে বিপর্যয়ের পরে দলকে ঘুরে দাঁড় করাতে কারাটের দাওয়াই, রাজনীতির নতুন পথে হাঁটতে হবে। নতুন স্লোগান চাই। এমন বিষয়ে আন্দোলন করতে হবে, যেখানে মধ্যবিত্ত থেকে খেটে খাওয়া মানুষের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মও সামিল হতে পারে।
সিপিএমের সাধারণ সম্পাদকের আজকের সিদ্ধান্তে দলের অনেকেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-নিরুপম সেনদের জয় দেখছেন। কারণ বামফ্রন্ট সরকারের শেষ পর্বে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দলের চিন্তাভাবনা বদলের কথা বলেছিলেন বুদ্ধ-নিরুপমরা। ট্রেড ইউনিয়নের জুলুম, বন্ধ-অবরোধের রাজনীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন বুদ্ধদেব। বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের ছেলেমেয়েদের যাতে চাকরির খোঁজে বাইরে যেতে না হয়, সে জন্য ভারী শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের উন্নয়ন দরকার। বুদ্ধ-নিরুপমদের যুক্তি ছিল, শ্রমিক-কৃষকের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের ভাষাতেও কথা বলতে হবে। এঁদেরও প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করতে হবে। না হলে আগামী দিনে পার্টি বড় সমস্যায় পড়বে। যদিও এর আগে পশ্চিমবঙ্গে বামেদের বিপর্যয়ের জন্য বুদ্ধ-নিরুপমদের এই লাইনকেই দায়ী করেছিল কারাট-শিবির।
আজ কারাটের মুখে কিন্তু কার্যত বুদ্ধদেব-নিরুপমদের সেই লাইনেরই পুনরাবৃত্তি শোনা গিয়েছে। কারাটের বক্তব্য, দলের রাজনৈতিক লাইন পর্যালোচনা করতে হবে। আন্দোলনের অভিমুখ বদলাতে হবে। আন্দোলন হলেও আমজনতার মধ্যে কেন তার প্রভাব পড়ছে না, তা বুঝতে হবে।
শুধু রাজনৈতিক লাইন বদলের কথা নয়, লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবির দায়ও নিয়েছেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। কারাটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা, এই বিপর্যয়ের মূল দায় পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। সেই সঙ্গে বাংলায় খারাপ ফলের দায় এ বার তিনি আলিমুদ্দিনের ঘাড়ে চাপাননি। বলেছেন, “কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দলের নিজস্ব শক্তি ও প্রভাব বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। জনভিত্তি কমেছে। ভোটে তারই প্রতিফলন দেখা গিয়েছে।”
দলের খারাপ ফল প্রসঙ্গে কারাটের স্বীকারোক্তি, আর্থিক উদারীকরণের সুফল সব মানুষই পেয়েছেন। তাঁদের চিন্তাভাবনাও বদলেছে। নতুন বিনিয়োগ, শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র এই উন্নয়নে সকলেই সামিল হতে চায়। অথচ সিপিএম লড়েছে সেই উদার আর্থিক নীতির বিরুদ্ধেই। কারাটের দাওয়াই, আর্থিক উদারীকরণের এই দু’দশকে সমাজের সব শ্রেণির চিন্তাভাবনা কী ভাবে বদলেছে, তা খতিয়ে দেখা হবে। তার জন্য দলের নেতাদের সঙ্গে অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদ ও অন্য বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগানো হবে। সেই অনুযায়ীই তৈরি হবে নতুন স্লোগান, নতুন রাজনৈতিক লাইন।
কারাটের এই ‘বোধোদয়’ নিয়ে অবশ্য দলেই প্রশ্ন উঠছে। অনেকেই বলছেন, এই ভাবে সব ভুল স্বীকার করে নতুন করে সাজিয়ে তোলার পরিকল্পনার আড়ালে কারাট আসলে দলে নিজের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চাইছেন। কারাট ২০০৫ সালে সাধারণ সম্পাদক হন। আগামী বছর তাঁর মেয়াদ ফুরোচ্ছে। কারাটের জমানাতেই দলের শক্তিক্ষয় হয়েছে, সাংসদ কমেছে, জনসমর্থনে ভাটার টান। এর কোনওটারই দায় এড়াতে পারেন না কারাট। পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে তাই কারাটকেই সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। দলীয় সূত্রে খবর, কারাট-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিতরাও এ বার তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন।
সিপিএমের অনেক নেতা মনে করছেন, চাপের মুখে হারের দায় নিয়ে পুরনো ধ্যানধারণা ভাঙার কথা বলে আসলে ফের দলের আস্থা অর্জন করতে চাইছেন কারাট। বোঝাতে চাইছেন, তিনিই হাল শোধরাবেন। সে জন্য নিজে শীর্ষপদ থেকে সরে গেলেও তাঁর আস্থাভাজন এস আর পিল্লাইকে বসাতে সক্রিয় কারাট। কিন্তু সিপিএমের একাধিক শীর্ষ নেতা কারাটের এই কৌশল আটকাতে মরিয়া। অনেকের মতে, লড়াইটা এখন কারাটের সঙ্গে সীতারাম ইয়েচুরির, নীতিগত ভাবে যিনি অনেকটাই উদারপন্থী।
আর্থিক উদারীকরণের দু’দশক পরে ভোলবদলের কাজ কতটা সম্ভব হবে? কারাটের যুক্তি, “গত ৫-৬ বছর ধরেই বিচ্ছিন্ন ভাবে এ সব নিয়ে আলোচনা করছি। এ বার সামগ্রিক ভাবে কাজটা হবে। সেই অনুযায়ী পার্টি কংগ্রেসের আগে রাজনৈতিক রণকৌশল ও সাংগঠনিক কাজকর্মের ধরনে রদবদল হবে।”