সময় তখন সকাল ১০টা ৫৫ মিনিট। দিল্লি থেকে রিমোট কন্ট্রোলে রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু যাত্রা শুরুর বোতাম টিপলেন। সেই সঙ্গেই শিলচর স্টেশনে রেল প্রতিমন্ত্রী মনোজ সিংহের হাতে উঠে এল সবুজ পতাকা। তুমুল হাততালি আর জয়ধ্বনিকে সাক্ষী রেখে যাত্রা শুরু করল ০৫৬১৬ নম্বর শিলচর-গুয়াহাটি বিশেষ প্যাসেঞ্জার। বরাকবাসীর স্বপ্নের ট্রেন। শিলচর থেকে গুয়াহাটিগামী
প্রথম ব্রডগেজ ট্রেনের জন্য বরাকবাসীর ১৯ বছরের অপেক্ষা অবশেষে শেষ হল আজ।
লামডিং থেকে শিলচর অবধি মিটারগেজ ট্রেনের চলা শুরু ১৮৯৯ সালে। বরাইল পাহাড়ের বুক চিরে প্রথমে কয়লার ইঞ্জিন চলত পরে আসে ডিজেল ইঞ্জিন। ১৯৯৬ সালে লামডিং থেকে শিলচর অবধি মিটারগেজ লাইনকে ব্রডগেজ করার কথা ঘোষণা করা হয়। ২০০৪ সালে এই প্রকল্পকে জাতীয় প্রকল্প হিসাবে ঘোষণা করা হলেও জঙ্গি সমস্যা ও অনিয়মিত অর্থ বরাদ্দ হওয়ার ফলে ক্রমেই বিলম্বিত হয় ব্রডগেজের কাজ। এই বছর এপ্রিলে মিটার গেজের পাশ দিয়েই ব্রডগেজের লাইন পাতার কাজ শেষ হয়। শুধু ২০ কিলোমিটার লাইন অন্য পথে ঘুরিয়ে পাতা হয়েছে। পরীক্ষামূলক ভাবে নিয়মিত মালবাহী ট্রেন ও ব্যালাস্ট ট্রেন চালাবার পরে যাত্রী-ট্রেন চালাবার সবুজ সংকেত দেয় রেলের নির্মাণ ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। প্রথমে ঠিক হয় ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ট্রেন চলবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে উদ্বোধনের দিন এগিয়ে এনে কার্যত চার দিনের প্রস্তুতিতে যাত্রী-ট্রেন চালানো হল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান প্রথমে গুয়াহাটিতে হওয়ার কথা থাকলেও বরাকবাসীর আবেগের কথা ভেবে তা শিলচরে স্থানান্তরিত করা হয়।
আজ সকাল ১০টা ২৭ মিনিটে রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু সরাসরি ভিডিও সম্প্রাসারণের মাধ্যমে শিলচর স্টেশনে হাজির রেল প্রতিমন্ত্রী ও রেল কর্তাদের সঙ্গে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন করিমগঞ্জের সাংসদ রাধেশ্যাম বিশ্বাস। প্রভু বলেন, ‘‘এই .যাত্রার আনন্দে কেবল বরাকের মানুষ নন, গোটা দেশ শরিক। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলি ব্রডগেজে যুক্ত হলে দেশেরই গর্ব। শীঘ্রই বদরপুর-কুমারঘাট-আগরতলা সেকশন এবং অরুণাচলপ্রদেশ ও মণিপুরের জিরিবামে ব্রডগেজ ট্রেন চলা শুরু হবে। সব রাজ্যের রাজধানী
ব্রডগেজ রেল নেটওয়র্কে জোড়া হচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গেও রেল যোগাযোগে গুরুত্ব দিচ্ছে কেন্দ্র। তাই শিলচরের গুরুত্ব আরও বাড়তে চলেছে। এই অঞ্চলের মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে অনেক সুযোগ। উত্তর-পূর্বের রেল পরিকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করা হবে ছ’হাজার কোটি টাকা।’’ গুয়াহাটি অবধি ব্রডগেজ চালু হওয়ার পর ত্রিপুরার আগরতলা, মণিপুরের জিরিবাম ও মিজোরামের ভৈরবীর মানুষও আশায় বুক বেঁধেছেন। প্রভু জানান, আগামী বছরই এই সব এলাকা ব্রডগেজে যুক্ত হবে। নতুন পথে চলবে আরও বেশ কিছু ট্রেন।
ট্রেন নিয়ে মানুষের উচ্ছ্বাস দেখে অবাক মনোজ সিংহ বলেন, ‘‘গেজ বদলে এমন আনন্দ হতে পারে— তা এখানে না এলে বুঝতাম না। এই আবেগকে প্রণাম জানাই। বরাকবাসীর দাবি মেনে শীঘ্রই কলকাতা ও দিল্লির সঙ্গে শিলচরকে সরাসরি যুক্ত করা হবে।’’ আমন্ত্রণপত্র বা ফলকে কোথাও বাংলা ব্যবহার না হওয়ায় বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদ জানায়। একটি ট্রেনের নাম ‘ভাষা শহীদ এক্সপ্রেস’ করার দাবিও উঠেছে। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সিংহ বলেন, ‘‘দিল্লি থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় বাংলা বাদ পড়েছে। ভবিষ্যতে স্থানীয় আবেগকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হবে। বিশেষ জোর দেওয়া হবে যাত্রী নিরাপত্তায়।’’
রেলের তরফে আমন্ত্রণ পেতে দেরি হওয়ায় ক্ষোভ জানালেও আজ অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন কংগ্রেসের সাংসদ সুস্মিতা দেব। আসেন রাজ্যের দুই মন্ত্রী গৌতম রায় ও অজিত সিংহ। সুস্মিতাদেবী প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে ব্রডগেজ প্রকল্পের পিছনে তাঁর বাবা সন্তোষমোহন দেব ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের অবদানের কথা মনে করিয়ে দেন।
তবে, প্রথম ট্রেন ধরতেই দেরি করে ফেললেন কেন্দ্রীয় ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল এবং সাংসদ রমেন ডেকা। তাঁরা যখন শিলচর স্টেশনে এসে পৌঁছান তখন ট্রেন অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে। সোনোয়াল বলেন, ‘‘সড়কপথের যন্ত্রণায় বরাকের মানুষ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ব্রডগেজ আবার দুই উপত্যাকাকে অনেক কাছাকাছি নিয়ে এল। আজ ঐতিহাসিক সেতুবন্ধনের দিন।’’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শিলচরের বিধায়ক দিলীপকুমার পাল, উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের দুই জেনারেল ম্যানেজার এইচ কে জাগ্গি ও মহম্মদ জামসেদ এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কবীন্দ্র পুরকায়স্থ।