আম আদমির জয়গান গেয়েই দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদীকে কুপোকাত করেছেন অরবিন্দ কেজরীবাল। এ বার সেই আম আদমির কথা বলেই মোদী সরকারের নীতির বিরোধিতা করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিজেপি নেতা, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তা কুমারের নেতৃত্বাধীন উচ্চ পর্যায়ের কমিটি সম্প্রতি খাদ্য সুরক্ষা আইনের পরিধি কমিয়ে আনার সুপারিশ করেছে। কমিটির দাওয়াই, দেশের জনসংখ্যার ৬৭% মানুষকে খাদ্য সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসার প্রয়োজন নেই। তার বদলে ৪০% মানুষকে খাদ্য সুরক্ষা দেওয়া হোক। যুক্তি, এতেই দারিদ্রসীমার নীচের সবাই খাদ্য সুরক্ষার আওতায় চলে আসবেন। ভর্তুকির বহরও এক ধাক্কায় ৩০ হাজার কোটি টাকা কমে যাবে।
‘গরিবের স্বার্থবিরোধী’ সুপারিশ খারিজ করে দেওয়ার দাবিতে কড়া ভাষায় প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের মুখ্যসচিব বা অন্য আমলা এই চিঠি লিখতে পারতেন। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে না লিখে খাদ্যমন্ত্রীকেও লেখা যেত। কিন্তু সে পথে না হেঁটে মুখ্যমন্ত্রী নিজে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, “আমি যাবতীয় গরিব বিরোধী সুপারিশ খারিজ করে দেওয়ার জন্য আপনাকে আর্জি জানাচ্ছি।”
অনেকে মনে করছেন, তৃণমূল নেত্রী নিজের ‘গরিব দরদি’ ভাবমূর্তিকেই আরও তুলে ধরতে চাইছেন। গরিবদের স্বার্থরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েই দিল্লিতে বিজেপিকে ধরাশায়ী করেছে আপ। এই জয় তৃণমূলকে মনোবল জুগিয়েছে। মমতা মনে করছেন, গরিবদের পক্ষে দাঁড়ালে বিজেপিকে রোখা যাবে। তাই শান্তা কুমার কমিটির রিপোর্টের বিরোধিতা করেছেন মমতা। বিজেপি-বিরোধী দলগুলি যাতে মোদী-সরকারের নীতির বিরুদ্ধে একসুরে কথা বলে, সেই চেষ্টাও করছেন তিনি। ঠিক যে ভাবে শীতকালীন অধিবেশনে রাজ্যসভায় সরকার বিরোধিতায় সব দলকে একজোট করেছিল তৃণমূল।
কোন যুক্তিতে শান্তা কুমার কমিটির বিরোধিতা?
মমতা চিঠিতে লিখেছেন, “কমিটির সুপারিশ কার্যকর হলে তার কী ফল হবে, তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। কমিটি যে ভাবে রাজকোষের উপর চাপ পড়বে বলে যুক্তি দিয়ে খাদ্য সুরক্ষার পরিধি ৬৭ থেকে ৪০%-এ কমিয়ে আনার সুপারিশ করেছে, তাতে অবাক হয়ে যাচ্ছি।” খাদ্য সুরক্ষায় ছ’মাসের রেশন এক বারে মানুষের হাতে তুলে দেওয়া, খাদ্যের বদলে অর্থ দেওয়ার মতো যে সব সুপারিশ করেছেন শান্তা কুমার, তারও বিরোধিতা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর যুক্তি, “এ সব গরিব মানুষের খাদ্যের অধিকারে আঘাত হানবে।”
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে মোদী বলেছিলেন, এফসিআই-কে ঢেলে সাজা প্রয়োজন। এফসিআই ভেঙে খাদ্য অধিগ্রহণ, মজুত ও বন্টন করার তিনটি পৃথক সংস্থা তৈরির সম্ভাবনার কথাও বলেছিলেন তিনি। তা হলে প্রতিটি সংস্থাই দক্ষ ভাবে কাজ করবে। কী ভাবে তা করা যায়, তা খতিয়ে দেখতেই শান্তা কুমারের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তৈরি হয়েছিল। জানুয়ারি মাসে কমিটি রিপোর্ট দিলে দেখা যায়, এফসিআইকে ঢেলে সাজার কথা ছাড়াও আরও একগুচ্ছ সুপারিশ করেছে কমিটি। যার মধ্যে ভর্তুকির বহর কমাতে খাদ্য সুরক্ষার পরিধি কমানোর সুপারিশও রয়েছে। একই ভাবে সার বাবদ ভর্তুকি সরাসরি কৃষকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যার ফলে বছরে ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার বোঝা কমবে বলেই কমিটির মত। এই বিষয়টি নিয়েই আপত্তি তুলেছেন মমতা। তাঁর বক্তব্য, “যেটুকু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, কমিটি তার বাইরে গিয়েও বহু সুপারিশ করেছে।”
আগে সিপিএমও এই রিপোর্টের বিরোধিতা করেছিল। যুক্তি ছিল, সুপারিশ কার্যকর হলে খাদ্যশস্য অধিগ্রহণ, মজুত ও বন্টনের ব্যবস্থাটাই সরকারের থেকে বাজারের হাতে চলে যাবে। আর মমতা জানিয়েছেন, “এফসিআইয়ের উন্নতির জন্য পদক্ষেপ হলে তাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু খাদ্য সুরক্ষা আইনের প্রধান লক্ষ্য গরিবরা। সেখানে আঘাত করা উচিত নয়।”
কী বলছে কেন্দ্রীয় সরকার?
খাদ্য মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, শান্তা কুমার কমিটির মূল বক্তব্য হল, প্রকৃত গরিবদেরই খাদ্য সুরক্ষা দেওয়া হোক। যাদের দরকার নেই, তাদের পিছনে ভর্তুকি ব্যয় করে লাভ নেই। সেই কারণে ৬৭%-র বদলে ৪০%-র জন্য খাদ্য সুরক্ষার কথা বললেও মাথাপিছু খাদ্যশস্যের পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। আইনে সকলকেই মাসে মাথাপিছু ৫ কেজি খাদ্যশস্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কমিটির সুপারিশ, দারিদ্রসীমার নীচের মানুষদের মাসে মাথাপিছু ৭ কেজি খাদ্যশস্য দেওয়া হোক। খাদ্য মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, “প্রধানমন্ত্রী কমিটির সুপারিশ খতিয়ে দেখে খাদ্য মন্ত্রককে মতামত জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন। সেই কাজই চলছে। তবে কয়েকটি রাজ্যও আপত্তি তুলেছে। তাদের মতামতও খতিয়ে দেখা হবে।”