কাজে গতি চাই, পয়লা বৈঠকে স্পষ্ট বার্তা মোদীর

লাল ফিতে নয়। বিনিয়োগের জন্য লাল কার্পেট। আর বিদেশ থেকে কালো টাকা উদ্ধারের জন্য শক্ত ফাঁস। নরেন্দ্র মোদীর এই নীতি মেনেই কাজ শুরু করে দিল তাঁর সরকার। লাল ফিতের ফাঁসে আটকে রয়েছে ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প। বিভিন্ন মন্ত্রকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ক্যাবিনেট সচিব অজিত শেঠ প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি রিপোর্ট তৈরি করেছেন। যে রিপোর্ট অনুযায়ী, এই সব আটকে থাকা প্রকল্পের মধ্যে প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্পে এখনই ছাড়পত্র দেওয়া যায়।

Advertisement

দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৪ ০২:৪৭
Share:

লাল ফিতে নয়। বিনিয়োগের জন্য লাল কার্পেট। আর বিদেশ থেকে কালো টাকা উদ্ধারের জন্য শক্ত ফাঁস।

Advertisement

নরেন্দ্র মোদীর এই নীতি মেনেই কাজ শুরু করে দিল তাঁর সরকার। লাল ফিতের ফাঁসে আটকে রয়েছে ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প। বিভিন্ন মন্ত্রকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ক্যাবিনেট সচিব অজিত শেঠ প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি রিপোর্ট তৈরি করেছেন। যে রিপোর্ট অনুযায়ী, এই সব আটকে থাকা প্রকল্পের মধ্যে প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্পে এখনই ছাড়পত্র দেওয়া যায়। এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে যাত্রার শুরুতেই ইতিবাচক বার্তা দিতে চায় সরকার। আজ মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে তার পথ বাতলে দিলেন নতুন প্রধানমন্ত্রী।

একই সঙ্গে বিদেশি ব্যাঙ্কে গচ্ছিত কালো টাকা উদ্ধারে একটি বিশেষ তদন্তকারী দল (এসআইটি) তৈরি করে দিয়েছেন মোদী। এই দল অবশ্য গড়া হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। কালো টাকার বিষয়ে নজরদারি শুরু করতে গত সপ্তাহেই এক সপ্তাহ সময় দিয়েছিল শীর্ষ আদালত। ফলে আগামিকালের মধ্যেই এই এসআইটি গঠন করতেই হতো। কিন্তু মোদী বেনজির ভাবে এটিকে এমন ওজনদার বানালেন, যাতে মনে হয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের থেকে তাঁর সরকারের তাগিদ অনেক বেশি। সে কারণে হেভিওয়েট আমলাদেরও এই দলে সামিল করা হয়েছে।

Advertisement

মনমোহন সিংহের সরকারের বিরুদ্ধে সব থেকে বড় অভিযোগ ছিল নীতিপঙ্গুত্ব বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষমতা। একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগের ধাক্কায় ইউপিএ সরকারের মন্ত্রী, আমলারা ফাইলে সই করতেই ভয় পাচ্ছিলেন। ক্যাবিনেট সচিবালয়ের হিসেব বলছে, এই মুহূর্তে ৪৩০টি প্রকল্প লাল ফিতের ফাঁসে আটকে রয়েছে। এগুলির বিনিয়োগ মূল্য অন্তত ২০ লক্ষ কোটি টাকা।

একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি চান না মোদী। বিশেষ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার পরে। মোদী জানেন, আগের সরকারের নীতিপঙ্গুত্বের বিরুদ্ধেই তাঁকে এই বিপুল সমর্থন দিয়েছে জনতা-জনার্দন। তাঁর দিকে অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে নবীন প্রজন্ম। এই অবস্থায় আটকে থাকা প্রকল্পগুলিকে ছাড়পত্র দিলে অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার হবে।

আজ বিকেলে নতুন মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী জানান, কোথায়, কী কী প্রকল্প আটকে রয়েছে, তার তালিকা তাঁর কাছে রয়েছে। মন্ত্রীদের কাজ হবে, কার মন্ত্রকে কোথায় কী বাধা রয়েছে, তা চিহ্নিত করে সেগুলিতে ছাড়পত্র দেওয়া। মোদী জানিয়ে দিয়েছেন, এ সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত যেন আটকে না থাকে। নীতিপঙ্গুত্ব কাটিয়ে ওঠাটা মোটেই কঠিন কাজ নয়।

বৈঠকে মোদী স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, বিজেপি এত দিন মনমোহন সরকারের যে সব ভুলভ্রান্তির সমালোচনা করছিল, সেগুলো ভুলে গেলে চলবে না। কয়লাখনি বণ্টনের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পিছনে মূল কারণ ছিল সঠিক নীতির অভাব। কাজেই প্রথমেই নীতি রূপায়ণ করতে হবে মন্ত্রকগুলিকে। মন্ত্রীরা কী ভাবে কাজ করবেন, আজ তারও রূপরেখা বলে দিয়েছেন মোদী।

প্রাথমিক ভাবে চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নীতি তৈরি করতে ফেলতে চাইছে নতুন সরকার। l বিভিন্ন আটকে থাকা প্রকল্পে দ্রুত ছাড়পত্র দিতে নতুন ব্যবস্থা তৈরি করা। l ইউপিএ সরকারের বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পগুলির পর্যালোচনা করে নতুন করে ঢেলে সাজা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখা। l কর্মসংস্থান তৈরি করতে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ সম্পর্কে নতুন নীতি তৈরি করা। l জ্বালানি ও রান্নার গ্যাসের ভর্তুকির বহর কমানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া।

সরকারি সূত্রের খবর, আটকে থাকা কাজে গতি আনতে পরিকাঠামো ক্ষেত্রের প্রকল্পগুলির উপর সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় নজর রাখবে। অন্যান্য প্রকল্পের কাজেও গতি আনতে বিভিন্ন মন্ত্রকের মধ্যে কী ভাবে সমন্বয় আনা যায়, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মনমোহন সরকার একেবারে শেষবেলায় এসে বিনিয়োগ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার কমিটি তৈরি করেছিল। সেই কমিটি প্রায় ৫ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্পে ছাড়পত্র দেয়। তার মধ্যে ৪ লক্ষ কোটি টাকার কাজ শুরু হয়েছে। এ বার প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের অধীনেই সেই রকম একটা ব্যবস্থা তৈরি করা হতে পারে।

সরকারি সূত্রের বক্তব্য, দীর্ঘদিন আটকে থাকা প্রকল্পের সিকিভাগ মাত্র কেন্দ্রীয় সরকারি স্তরে আটকে আছে। বাকি তিন ভাগের কাজ শুরু হয়নি রাজ্যগুলির ছাড়পত্রের অভাবে। তাই এ ব্যাপারে রাজ্যগুলির সহযোগিতা পাওয়ার জন্য তৎপর হবে কেন্দ্র।

ভোট-প্রচারে ইউপিএ সরকারের খয়রাতি নীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন মোদী। তাঁর সরকার মনে করে, ১০০ দিনের কাজ থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো ক্ষেত্রে অনেক সামাজিক প্রকল্পকেই মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে। যাদের প্রয়োজন নেই, তাদের বাদ দিয়ে কী ভাবে নিম্নবিত্ত ও গরিবদের কাছে এই সব প্রকল্পের সুবিধা পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে সেটা দেখবে নয়া সরকার। গাড়ির জ্বালানি ও রান্নার গ্যাসের ভর্তুকির ক্ষেত্রেও একই নীতি নিয়ে চলতে চাইছে মোদী সরকার।

মোদী-মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকের পরে কেন্দ্রীয় আইন ও বিচারমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ জানান, কালো টাকা উদ্ধারে যে বিশেষ তদন্তকারী দল (এসআইটি) গড়া হয়েছে তাঁর নেতৃত্ব দেবেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম ভি শাহ। ভাইস চেয়ারম্যান হবেন শীর্ষ আদালতেরই আর এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অরিজিৎ পাসায়াত।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এই দলটি গড়া হলেও ভোট প্রচারে কালো টাকা উদ্ধার নিয়ে লাগাতার প্রচার করেছেন মোদী। লালকৃষ্ণ আডবাণী তো রথযাত্রাও করেছিলেন একই দাবিতে। সরকারে এসে মন্ত্রিসভার প্রথম সিদ্ধান্ত যাতে নজরকাড়া হয়, তার জন্য মোদী ওই তদন্তকারী দলে সামিল করেছেন সিবিআই এবং আইবি-র প্রধানকে। রাখা হয়েছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেক্ট, সিবিডিটি-র চেয়ারম্যান, র-এর প্রধান, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নর, রাজস্ব সচিবকেও।

এই হেভিওয়েট তদন্তকারী দল বিদেশে কত কালো টাকা রয়েছে, সেগুলি কী ভাবে ফিরিয়ে আনা যায়, সে সব খতিয়ে দেখে রিপোর্ট পেশ করবে। তার ভিত্তিতেই সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ মেনে পদক্ষেপ করবে কেন্দ্র।

তবে এ ক্ষেত্রে বড় একটি বিষয় হল বিভিন্ন রাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া। সুইৎজারল্যান্ডের মতো দেশ আমেরিকাকে তথ্য দিয়েছিল। কিন্তু ভারতের সঙ্গে সে ভাবে সহযোগিতা করেনি। এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেন, “অনেক কিছুই নির্ভর করে ভারত কী বার্তা দিচ্ছে তার উপরে। সরকার শক্তিশালী হলে ও দেশের অর্থনীতির হাল ফিরলে অন্য রাষ্ট্রও সহযোগিতা করতে বাধ্য হবে।”

নতুন প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্যই হল সরকারের কাজে দক্ষতা ও গতি আনা। প্রথম বৈঠকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফের মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকেছেন মোদী। দলীয় সূত্রের খবর, সংসদের অধিবেশনের দিনক্ষণ নিয়ে কথা হতে পারে আগামিকালের বৈঠকে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement