এত দিন যারা ছিলেন ব্রাত্যজন, তাঁরাই এখন সুজন। বাম দলের সংখ্যা চার থেকে বেড়ে হল ছয়।
রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা টিকিয়ে রাখতে এ বার সিপিআই (এম-এল) ও এসইউসি (সি)-র সঙ্গে যৌথ আন্দোলনের ডাক দিলেন প্রকাশ কারাট, এ বি বর্ধনরা। এই দুই দলের সঙ্গে সিপিএম, সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি একসঙ্গে এই প্রথম রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে চলেছে।
দু’দিন আগেই সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আর ‘তৃতীয় ফ্রন্ট’ নয়। কখনও মুলায়ম, কখনও মায়াবতী, কখনও নীতীশ কুমার, কখনও আবার জয়ললিতা কিংবা চন্দ্রবাবু নায়ডুদের সঙ্গে নিয়ে সিপিএম আর তৃতীয় ফ্রন্ট তৈরির চেষ্টা করবে না। এই আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিতে কোনও রকম নির্বাচনী আঁতাঁত হবে না। আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক আন্দোলন হতে পারে। কিন্তু উদার অর্থনীতি ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনের জন্য প্রথমে চার বাম দলের গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে অন্য বাম দলগুলির সঙ্গেও ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করবে সিপিএম।
সেই উদ্দেশ্যেই আজ দিল্লির এ কে গোপালন ভবনে চার বাম দলের নেতারা সিপিআই (এম-এল) ও এসইউসি (সি)-র সঙ্গে বৈঠক বসেন। দিল্লিতে বসে গাঁটছড়া বাঁধার সিদ্ধান্ত নিলেই নিচু তলায় কর্মীদের মধ্যে জোট হবে কি না, তা নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের দুশ্চিন্তা ছিল। সে কারণেই কোনও সভাঘরে সম্মেলনের ডাক না দিয়ে পথে নেমে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে প্রকাশ কারাট বলেন, “৮ থেকে ১৪ ডিসেম্বর প্রতিবাদ কর্মসূচির সিদ্ধান্ত হয়েছে। মোদী সরকারের উদার অর্থনীতি, লাভ জেহাদ থেকে শুরু করে শিক্ষায় আরএসএস ও হিন্দুত্ব মতাদর্শের অনুপ্রবেশের মতো সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা হবে।” ফব-র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত বিশ্বাস বলেন, “নিচু তলার কর্মীরা একে অন্যকে আগে চিনুন। তার পরে আরও বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।”
সাম্প্রতিক অতীতে সিপিআই (এম-এল)-র সঙ্গে বিহারের মতো কিছু রাজ্যে সিপিএমের সমঝোতা হয়েছে। কিন্তু অনেক বিষয়ে এক দল আর এক দলের কড়া সমালোচনাও করেছে। একই ভাবে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো এলাকায় সিপিএম-এসইউসি-র বিরোধ আছে।
এই দূরত্ব কি মেটানো যাবে?
সিপিআই (এম-এল)-র পলিটব্যুরো নেত্রী কবিতা কৃষ্ণন বলেন, “আমরাও মনে করছি, ঐক্যের প্রয়োজন রয়েছে। পাঁচ-ছয় মাস আগেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার পর সিপিএম ও অন্য বাম দলগুলিকে সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলাম। সাড়াও পেয়েছি।”
পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু চার বাম দলের গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে বৃহত্তর বাম ঐক্যের এই প্রচেষ্টা আগেই শুরু করেছেন। তিনি অন্য বাম দলের দফতরে গিয়ে বৈঠক করেছেন। প্রকাশ কারাটও কলকাতায় গিয়ে এসইউসি-র মতো বাম দলগুলির সিপিএমের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনেছেন। চেষ্টা করেছেন দূরত্ব কমানোর। কিন্তু সদ্য অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে দলের অন্দরে মতৈক্য গড়ে তুলতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে কারাটকে। তিনি বৃহত্তর বাম ঐক্যের পক্ষে। এই ঐক্য যাতে না ভাঙে, সে জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার রাস্তা বন্ধ করে দিতে চান কারাট। কিন্তু সীতারাম ইয়েচুরি ও পশ্চিমবঙ্গ নেতৃত্বের একাংশ চান বিজেপি-কে ঠেকাতে কংগ্রেসের সঙ্গে আঁতাঁতের দরজা খোলা রাখতে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠিক হয়েছে, কংগ্রেসের সঙ্গে গণ আন্দোলন হতে পারে। যেমন বাম ও কংগ্রেসি শ্রমিক সংগঠনগুলি একসঙ্গে আন্দোলন করছে। কিন্তু নির্বাচনী আঁতাঁত হবে না। আজকের এই বৈঠকে ইয়েচুরি যোগ দেননি। সিপিএমের প্রতিনিধিত্ব করেছেন কারাট ও এস আর পিল্লাই। কারাট অবশ্য দাবি করেছেন, দলের মধ্যে এ বিষয়ে কোনও বিভাজন নেই।
তিন বছর আগে পার্টি কংগ্রেসেও সিপিএম বাম ঐক্য মজবুত করার ডাক দিয়েছিল। তার পর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সিপিএম প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থন করায় চার বাম দলের মধ্যেই ফাটল ধরেছিল। ফব সিপিএমের রাস্তায় গেলেও সিপিআই ও আরএসপি সে পথে হাঁটেনি। সিপিএম আবার কংগ্রেসের প্রতি নরম সুর নিলে কী হবে? আরএসপি নেতা ক্ষিতি গোস্বামী বলেন, “রাজনীতিতে তো অসম্ভব বলে কিছু নেই। কিন্তু যে ভাবে বিপদ চেপে ধরেছে, তার পরে আর উল্টো দিকে হাঁটার সম্ভাবনা কম।”