চোখ খুলে দিয়েছে মালয়েশীয় বিমানের অন্তর্ধান রহস্য। যা থেকে শিক্ষা নিয়ে অভিবাসনের চোখ এড়ানো অবৈধ পাসপোর্ট ধরতে মাঠে নামল খোদ ইন্টারপোল। এ জন্য তারা একটি সফ্টওয়্যার তৈরি করেছে। ইন্টারপোল চায়, সমস্ত বিমানসংস্থা সেটি কাজে লাগাক। কিন্তু মালয়েশিয়া ও কাতারের দু’টি বিমানসংস্থা যেখানে ইতিমধ্যে প্রযুক্তিটির ব্যবহার চালু করে তার সম্প্রসারণেরও কথা ভাবছে, সেখানে ভারতীয় বিমানসংস্থারা এখনও ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনাই শুরু করেনি।
চলতি বছরের ৮ মার্চ কুয়ালালামপুর থেকে বেজিংগামী মালয়েশীয় এয়ারলাইন্সের এমএইচ-৩৭০ বিমানটি মাঝ আকাশে সেই যে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে, ন’মাসেও তার হদিস মেলেনি। তদন্তকারীদের সন্দেহের তির দুই যাত্রীর দিকে, চোরাই পাসপোর্ট নিয়ে যাঁরা বিমানে উঠেছিলেন বলে পরে জানা গিয়েছে। ইন্টারপোলের তথ্য অনুযায়ী, অস্ট্রিয়া ও ইতালির পাসপোর্ট দু’টি তাইল্যান্ডে চুরি গিয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছে, সেই পাসপোর্ট নিয়ে অভিবাসনের নজর এড়িয়ে ওঁরা কী ভাবে বিমানে সওয়ার হলেন?
এমনই প্রেক্ষাপটে ইন্টারপোলের নতুন উদ্যোগ। অভিবাসন-পরীক্ষার ফাঁক গলে গেলেও অবৈধ পাসপোর্ট নিয়ে কেউ যাতে বিমানে চড়ে বসতে না-পারে, সে জন্য তারা একটি সফ্টওয়্যার বানিয়েছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘আই-চেকইট।’ মালয়েশিয়ার বেসরকারি বিমানসংস্থা এয়ার এশিয়া গত জুন থেকে এর সাহায্যে সমস্ত যাত্রীর পাসপোর্ট যাচাই করে নিচ্ছে। সম্প্রতি কাতার এয়ারলাইন্সও আই-চেকইট ব্যবহার শুরু করেছে। উল্লেখ্য, দু’টি এয়ারলাইন্সই কলকাতা থেকে আন্তর্জাতিক উড়ান চালায়। এবং দু’টিরই দাবি, পাসপোর্ট নজরদারির নতুন পদ্ধতিটির দৌলতে যাত্রী-নিরাপত্তা আরও সুনিশ্চিত হবে। যে কারণে তারা আরও ব্যাপক ভাবে তা প্রয়োগ করতে আগ্রহী।
ইন্টারপোলের সফ্টওয়্যার কাজ করে কী ভাবে? এয়ার এশিয়া সূত্রের খবর: নানা দেশে খোয়া যাওয়া কিংবা চুরি হওয়া পাসপোর্ট সংক্রান্ত তথ্য আই-চেকইটে মজুত করা হয়েছে। তার মাধ্যমে বিমানসংস্থার কর্মীরা নিজেদের কম্পিউটারে যে কোনও পাসপোর্টের নম্বর যাচাই করে নিতে পারেন। দেখা যায়, ওই নম্বরের কোনও পাসপোর্ট হারিয়ে বা চুরি গিয়েছিল কি না। তবে যে সব পাসপোর্টের বেহাত হওয়ার খবর নথিভুক্ত হয়েছে, শুধু সেগুলোরই তথ্য আই চেক-ইটে পাওয়া যাবে, তার বাইরে নয়। এয়ার এশিয়া জানাচ্ছে, এ পর্যন্ত সফ্টওয়্যারটি দিয়ে প্রায় ৬০ লক্ষ যাত্রীর পাসপোর্ট পরীক্ষা করা হয়। ৫৫টি সম্পর্কে আই-চেকইটে তথ্য মেলে। অভিবাসন সেগুলো খতিয়ে দেখে ১৮ জনকে বিমানে উঠতে দেয়নি। এয়ার এশিয়ার কর্তা টনি ফার্নান্ডেজ সম্প্রতি ইন্টারপোলের এক সভায় বলেন, “আই-চেকইটের সাহায্যে অবৈধ অনুপ্রবেশ অনেকটাই ঠেকানো গিয়েছে।”
ঘটনা হল, ভারতে জাল পাসপোর্ট চক্রের সক্রিয়তার প্রমাণ বারবার পাওয়া গিয়েছে। কখনও এ দেশের অভিবাসন দফতর টের না-পেলেও বিদেশের বিমানবন্দরে ধরা পড়ে গিয়েছেন অবৈধ পাসপোর্টধারী। বহু মানুষ জালিয়াতের পাল্লায় পড়ে বিদেশে ছোটখাটো চাকরি করতে গিয়ে পাসপোর্টের গোলমালে অশেষ ভোগান্তির শিকার হয়েছেন ও হচ্ছেন। তা সত্ত্বেও ভারতের সরকারি বা বেসরকারি বিমানসংস্থাগুলি এই মুহূর্তে ইন্টারপোলের নতুন অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার কথা ভাবছে না। স্পাইসজেট ও জেট ওয়ারওয়েজ এ প্রসঙ্গে মুখই খুলতে চায়নি। ইন্ডিগো জানিয়েছে, তারা এখনই নতুন ব্যবস্থা চালুর পক্ষপাতী নয়। আর এয়ার ইন্ডিয়া’র এক মুখপাত্র যুক্তি দিয়েছেন, “আমরা ডিজিসিএ (ডিরেক্টর জেনারেল অফ সিভিল অ্যাভিয়েশন, ভারতে অসামরিক বিমান পরিবহণের নিয়ন্ত্রক সংস্থা)-র নিয়ম মেনে চলি। সেখানে বিমানসংস্থার তরফে পাসপোর্ট পরীক্ষা করার কথা বলা হয়নি।”
ডিজিসিএ-র কী বক্তব্য?
তাদের এক কর্তা অবশ্য বলছেন, “নিরাপত্তার স্বার্থে বিমানসংস্থা বাড়তি পরীক্ষা করলে ক্ষতি কী? এ দেশের কোনও বিমানসংস্থা এয়ার এশিয়া-র মতো যাত্রীদের পাসপোর্ট যাচাই করলে আমাদের আপত্তি নেই।” কলকাতায় অভিবাসন দফতরের ডিসি দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, নানা ধরনের নথি বা তথ্য-প্রমাণ ঘেঁটেই পাসপোর্ট মেলানো হয়। “বিমান সংস্থাগুলো চাইলে যাত্রীদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করতেই পারে। কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।” মন্তব্য দিলীপবাবুর।
অর্থাৎ, নিয়মে না-থাকলেও নিজে থেকে উদ্যোগী হতে বাধা নেই। তবু বিমানসংস্থাগুলি যে ভাবে গা এলিয়ে রয়েছে, তা দেখে বিস্ময় জাগা স্বাভাবিক। প্রশ্ন উঠতে পারে, অন্য দেশ যেখানে দেখে শিখছে, ভারত কি সেখানে ঠেকে শেখার অপেক্ষায়?
সময়ই উত্তর দেবে।