এবার তো পঞ্জিকার বিধিতেই মস্ত গেরো। পঞ্জিকার তিথির গেরোয় নবমী পুজোর জন্য এক ঘণ্টা মোটে বরাদ্দ। শারদীয় দুগ্গোপুজোয় এমনিতেই শাস্ত্র মেনে সম্পূর্ণ করতে যথেষ্ট সময় লাগে। গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকা মতে ২ অক্টোবর সকাল ৮-২৯ মিনিট থেকে নবমী শুরু। পরে দিন সকাল ৬-২৯ পর্যন্ত নবমীর সময়। ও দিকে আবার রঘুনন্দন দুর্গোৎসব তত্ত্বের ভিত্তিতে ৩ অক্টোবর ৫-২৯ থেকে ৬-২৯ মিনিট নবমী তিথির স্বল্পতা। ইতিমধ্যে ছোট মাঝারি বড় বারোয়ারি পুজো উদ্যোক্তাদের মধ্যেও হয়তো কিছুটা উদ্বেগ রয়েছে।
প্রতিবেদনটা যখন লিখছি, এই মুহূর্তে কলকাতায় রয়েছি। পারিপার্শ্বিক দেখেশুনে ভাবছি, হলটা কি বাঙালির? বাঙালি বরাবরই হুজুগ প্রিয়। বাঙালি উৎসব প্রিয়ও। বারো মাসে বাঙালির নাকি তেরো পার্বণ। এ বার কলকাতায় এসে সেই বাঙালিকে দেখছি সিদ্ধির খোঁজে ‘গণপতি বাপ্পা’কে মণ্ডপে বসিয়ে, তারস্বরে মাইকে গণেশ বন্দনার হিন্দি সিডি চালিয়ে, হইহল্লা মাচিয়ে, জাঁকিয়ে পুজো করতে।
মুম্বইয়ের ক্রশ কালচার এখন বাঙালি মননেও। গণেশ পুজো নিয়ে বাঙালির মাতামাতি বেশ চমকপ্রদ। একটা সময় আমরা বিশ্বকর্মা পুজোর দিন থেকেই দিন গোনা শুরু করতাম। দুগ্গোপুজোর ক’দিন বাকি, মহালয়ার ক’দিন বাকি। ওই কাউন্টডাউন আর কী। এ বার কলকাতায় এসে গণেশ পুজোর বাড়বাড়ন্ত যা দেখছি, তাতে এখন থেকেই উৎসবের হাওয়া মাখছে বাঙালি।
কিশোরী বেলায় পয়লা বৈশাখ অক্ষয় তৃতীয়া উপলক্ষে দোকানগুলোয় ছোট গণেশ মূর্তি পুজো হতে দেখেছি। ইদানীং ভাদ্র মাসে গণেশ চতুর্থীতেও বাঙালির মাতামাতি। আর সেই রথযাত্রা থেকেই ‘খুঁটি পুজো’র নতুন হুজুগ তো রয়েছেই।
উৎসব প্রিয় বাঙালির সবার সেরা উৎসব দরজায় কড়া নাড়ছে। এ বার সপ্তমী তিথি বুধবারে পড়েছে। পঞ্জিকা মতে তাই এ বছর দুর্গা আসছেন নৌকায়। ‘মা আসছেন’ বাঙালির প্রার্থনায় আনন্দময়ীর আগমন হয় দিনগত পাপক্ষয় গতানুগতিক যাপনে সমস্ত হতাশা-বিপন্নতা-শোক-ব্যাকুলতা ঢেকে দেওয়ার প্রার্থনায়। আমরা বিশ্বাস করতে ভালবাসি, জগৎজননী মা আমাদের প্রতিটি মনোবাঞ্ছা পূরণ করবেন। রোজনামচা জীবনের নৈর্ব্যক্তিক বিষণ্ণতার ভার কাটিয়ে এক রাশ আনন্দ-অবকাশের আমেজ নিয়ে বাঙালির মহার্ঘ উৎসব শারদোৎসব হাজির।
হোক না সে পরবাস যাপন। ‘মা আসছেন’ এই বোধটুকু সম্বল করেই তো বছরভর অপেক্ষা শেষে জগৎজননীর মর্তে আগমন। এ বছর তাঁর নৌকায় আগমন। ফল জলবৃদ্ধি ও শস্যবৃদ্ধি। মুম্বই প্রবাসী বাঙালি মনে ঝালিয়ে নেওয়া বারমাস্যা ডিঙানো আবেগানুভূতি। তামাম বাঙালি হৃদয়ে এমন সময়টায় ছেয়ে থাকে কত যে মায়া, কত যে মরমি স্পর্শ এই দুর্গোৎসবকে সঙ্গে নিয়ে। মুম্বইয়ের বৈভব, নিজস্বতা, তার জৌলুস, তার চির প্রাণবন্তকে সাক্ষী রেখেই প্রবাস যাপনে অভ্যস্ত বাঙালির দুগ্গোপুজো আসলেই মন উড়ি উড়ি। শারদ উৎসবের দিনগুলো যত কাছে এগিয়ে আসে, ততই বাড়তে থাকে স্মৃতি কাতরতা। দুর্গাপুজোর উৎসবমুখর সন্ধ্যা-সকালগুলোর জন্য নতুন শাড়ি, জামাকাপড়ের পাটভাঙা গন্ধ। উৎসব মানেই নতুন পোশাক, খাওয়াদাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, দেদার আড্ডা। পুজো প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঢুঁ মারা, পুষ্পাঞ্জলি, রঙিন ভিড়, সাজগোজ, পুজোর জৌলুস, মণ্ডপে মণ্ডপে গুলতানি, আড্ডা সে এক অন্য ভাললাগা। অন্য অপেক্ষায় থাকা।
কলকাতায় তো জোরদার পুজো মরসুম শুরু হয়ে গেছে। আশ্বিনের আকাশ জুড়ে পুঞ্জ মেঘের আনাগোনা। শরৎ মেঘের মারকাটারি খেলাটাও ক্রমশ জমে উঠছে আকাশে। আর আকাশ জুড়ে রংবাহারি ঘুড়ির উড়ান। কখনও বা ভোকাট্টা। একে একে শারদীয় সংখ্যাগুলোও প্রকাশিত হচ্ছে। হাতে আসছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ও সমসাময়িক লিটল ম্যাগাজিনগুলোর শারদ সংখ্যা। টেলিভিশনের পর্দার কোণে কত দিন বাকি, তার হদিশ। পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, রাস্তার হোর্ডিং, ব্যানারে পুজোর নতুন কোনাকাটার হাল-হদিশ। সারা বছরের জন্য কেতাদুরস্ত পোশাক-আশাক কেনার তোড়জোড়। কলকাতার রাস্তায় বড় বড় হোর্ডিংয়ে কলকাতার এলিট পুজোগুলোর বিজ্ঞাপনের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় প্রতিটি ক্লাবই পুজোর বিজ্ঞাপন দিয়েছে।
অষ্টমী থেকেই কলকাতার পুজোর সেরাদের ফল ঘোষণা শুরু হয়ে যাবে। এখন তো পুজোমণ্ডপে থিম সং তৈরি করছেন নামী সঙ্গীতকারেরা ও সঙ্গীত পরিচালকরা। আলোর দায়িত্বেও স্থানীয় ডেকরেটর ছেড়ে সিনেমা বা মঞ্চে যাঁরা আলোকসম্পাতে বেশ খ্যাতির শীর্ষে তাঁরাই। হোর্ডিংয়ে হোর্ডিংয়ে ছয়লাপ কলকাতার মূল সড়কগুলি। সুরুচি সঙ্ঘ, নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘ, ত্রিধারা সম্মিলনী, ম্যাডক্স স্কোয়ার, অজেয় সংহতি, অগ্রণী, তেলেঙ্গাবাগান, আহিড়িটোলো সর্বজনীন ইত্যাদি।
কলকাতা কিংবা মুম্বই, পরবাস কিংবা নিজ বাসভূম, দূর কিংবা অদূর পুজো মানেই হর্ষ, পুজো মানেই উল্লাস বা কখনও স্মৃতিমেদুরতা। প্রতি বছর আশ্বিনের স্বল্পকালীন অস্তিত্বের এই দুর্গোৎসবকে ঘিরেই বাঙালির গড়পড়তা জীবনে হিসেবের বাইরে পাওয়া ক’টা আনন্দময় দিন। সম্ভ্রান্ত পাঁচটা দিন যদিও এ বছর তিথির গেরোয় মোটে চারটে সন্ধে-সকাল নিয়ে একটু মেতে থাকা। ওই যে, ‘মা আসছেন’ শাশ্বত ওই দুটি শব্দবন্ধনই তো মনের আসন খুলে রেখে অপেক্ষায় জিইয়ে রাখে।
‘অরুণ আলোর অঞ্জলি’ মেলে ঋতু বৈচিত্রের নিয়ম মেনেই শরৎ আসে। অথচ, পশ্চিম মুলুকে না দেখাই থেকে যায় দুর্বাদলের ওপর ভোরের শিশিরের ফোঁটাগুলো টলটলে হয়ে চেয়ে থাকা। না জানা উপলব্ধিতে থেকে যায় শিউলি ফুলের কমলা-সাদা আবেদন, মাঠে-ঘাটে কাশফুলের দোদুল্যমানতা, নীল আকাশে সাদা মেঘের মারকাটারি খেল, নবপত্রিকার বিস্তার, কুমোরটুলির মৃন্ময়ী শিল্পীদের হাতে মূর্তিগুলির ক্রমশ চিন্ময়ী রূপের প্রকাশপর্ব। আগমনীর আবহে বাঙালির ঘরে ফেরার গানে শারদোৎসব তখন আর উৎসবপ্রিয় বাঙালির মনোভাবে ধর্মীয় উৎসব হয়েই থাকে না। বদলে অনেক বেশি সামাজিক ব্যাঞ্জনাময় হয়ে ওঠে।
শিকড়ের টানটা যেন বড় বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। খাদ্য থেকে বাদ্য, পোশাক, পুজোর যথাবিহিত আয়োজন সব কিছুই শিকড়ের কাছাকাছি যাওয়ার প্রচেষ্টা। পুজোর ক’টা দিন বাংলার প্রাচীন শিল্প-সংস্কৃতি অনেক কিছুই হারানোর স্মৃতি উসকে দেয়। আজ এই বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তিগত নানা চাহিদা সত্ত্বেও দুর্গাপুজোর এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই মুম্বইয়ের মানুষজন, প্রবাস যাপনে ক্রমশ অভ্যস্ত এবং বছরের প্রায় ৩৬০ দিন নানান পেশাগত চাপে নিরন্তর ছুটে বেড়ানো বাঙালি এই দুগ্গোপুজোর ক’টা দিন একটু আয়েশে, একটু বেশি ‘বাঙালিপনা’ হুজুগে কাটাতে চায়। তবে খাতায়-কলমে দুর্গাপুজোর নির্ঘণ্ট যে ক’টা দিনই হোক, মুম্বইয়ে চাকরিরত বাঙালিদের অতগুলো ছুটিও বরাদ্দ থাকে না। কিছু প্রতিষ্ঠানে দশেরার দিনটুকুই ছুটি। নবরাত্রির দৌলতেই এই দশেরার ছুটিটাই প্রাপ্য। তা হোক। মুক্তির আনন্দ নিয়ে নতুন প্রাণ ও উদ্দমে নিজেকে মেলে ধরার মধ্যেই যেন সবুজ আশ্বাস।
মুম্বইয়ের নামী দামি প্রখ্যাত পুজো এবং আরও কয়েকটি বনেদি পুজোর আশনাই, মণ্ডপসজ্জা, আলোকসজ্জা, প্রতিমা, আঙ্গিক, রূপায়ণ, সামগ্রিক আয়োজন চোখে দেখা এবং টুকে রাখার মতো। বছরভর পর, দুর্গতিনাশিনীর মর্তে আগমনে, উৎসব সমাগমে সেজে ওঠেন প্রবাসী বাঙালির পরিবাররা। মুম্বইয়ের প্রতিটি পুজো মণ্ডপেই এখানকার প্রবাসীরা ধরে রাখতে চান এক টুকরো ‘কলকাতার ফ্লেভার’। পুজোর ক’টা দিন মণ্ডপে প্রবাসী বাঙালিদের মেলবন্ধন। মণ্ডপের মাইকে পুজোর আগমনী গান কিংবা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়ার মাতৃবন্দনা বাজছে। এ ছাড়াও বাঙালি খাবার-দাবারের শৌখিন স্টল, পশ্চিমবাংলার কিছু বস্ত্রশিল্প ও অন্যান্য বইয়ের স্টল। পুজোর ক’টা দিন দুপুরে এক সঙ্গে ভোগ খাওয়া। সর্বোপরি নতুন পোশাকে সুসজ্জিত বাঙালি নারীপুরুষের মিলনমেলা। মুম্বইয়ের প্রতিটি পুজো মণ্ডপে সর্বত্রই যথারীতি ‘বং কানেকশনস’।
শারদোৎসবের অদ্ভুত সৌকর্যের মাঝে মুম্বই যাপনের দিনগুলিতে তখন অন্য পরশ। নিখাদ বাঙালিয়ানার সঙ্গে মুগ্ধতার আঁচ নিয়ে দারুণ উৎসাহ-উদ্দীপনা। খোদ মুম্বইকররাও কিছুটা নিজেদের সামিল করে নেন মাতৃদর্শনে। তবে সে অর্থে সংখ্যায় কম। আসলে ওই একই সময়ে চলে জাগ্রত নবরাত্রি উৎসব। সে অনুষ্ঠানের আড়ম্বর, ব্যবস্থাপনা, জৌলুস, ব্রত, উপবাস, গুজরাতি সম্প্রদায়ের ‘গড়বা উৎসব’, ‘ডান্ডিয়া’ নাচ এ সবেই ব্যস্ত থাকেন তামাম উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের জনমানস। হয়তো যে জন্য দুর্গাপুজোয় মুম্বইয়ের বাঙালিরা খুব একটা কাছে পান না ভিন্ প্রবাসীদের।
ঢাকের বাদ্যি, কাঁসর-ঘণ্টা, ধনুচি নাচ, পুষ্পাঞ্জলি, কুমারীপুজো, আরতি, ভোগ, সিঁদুর খেলা ফেসবুক-ইন্সটাগ্রাম-ট্যুইটার-হোয়াটস অ্যাপ-এর যুগেও নিজস্ব আমেজটি সদা জাগ্রত থাকে। লাল শালু কাপড় মোড়া রঙিন পালকের ঝাড় লাগানো সুদৃশ্য ঢাকে কাঠি বাজিয়ে পশ্চিমবাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে মুম্বই পুজোর বায়না নিয়ে আসা ঢাকিরা যে বোল তোলেন যা সমস্ত বাঙালির নিজস্ব বিশ্বাস, আকুতি, প্রার্থনায় কাল্পনিক চাহিদা মতো অর্থবহ এক ছন্দ খুঁজে পান ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন’। কী অদ্ভুত মায়া।
মাত্র তিন দিন পরই বিশ্বকর্মা পুজো। হিন্দু ধর্মে বিশ্বকর্মা হলেন সৃজনের দেবতা।
“বিশ্ব কৃৎসন্ কর্ম ব্যাপারো বা যস্য সঃ”।
অর্থাৎ যাঁর সম্যক দৃষ্টি ও কর্ম জগৎব্যাপী প্রসারিত, তিনিই বিশ্বকর্মা। ভাদ্রপদ শুক্লা তিথির কন্যা সংক্রান্তিতে প্রতি বছর ১৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বকর্মা পুজোর রীতি। মূলত, কলকারখানা প্রযুক্তি সংক্রান্ত স্থলেই বিশ্বকর্মা পুজো পালিত হয়। একটা সময় হাওড়ায় খুব ধুম ছিল বিশ্বকর্মা পুজোর, সে দিন আর নেই।
বৈদিক পুরাণে ভগবান বিশ্বকর্মাকে ‘পাঁচ প্রজাপতির’ সৃষ্টিকর্তা রুপে বর্ণনা করা হয়েছে। বিশ্বকর্মার পাঁচ মুখাবয়ব থেকে সৃষ্ট হন সদ্যজাতা, বামদেব, অঘোরা, তৎপুরুষ, ঈশান। অর্থাৎ যথাক্রমে মনু, মায়া, তথ্য, শিল্পী, বিশ্বজন। যজুর্বেদে বিশ্বকর্মাকে ‘প্রজাপতি’ রূপে বিভূষিত করা হয়। অথর্ব বেদে ‘পশুপতি’ নামে। শ্বেতাশ্বোপনিষদে বিশ্বকর্মাকে বর্ণনা করা হয়েছে রুদ্রশিব রূপে। বৈদিক পরবর্তী যুগেও তাঁকে একাধারে ঋষি ও শিল্পী রূপে দেখা হয়েছে। যজুর্বেদে তিনি পাঁচ ঋষির অন্যতম। সূর্যের সাত রশ্মির এক রশ্মি রূপেও বিশ্বকর্মাকে মান্যতা দেওয়া হয়। স্বর্গের সমস্ত দেবতার রথ, অস্ত্র, অন্যান্য দৈব উপাচার সবই বিশ্বকর্মার সৃষ্ট। বিশ্বকর্মা সত্য যুগে দেবতাদের জন্য ‘স্বর্গলোক’ নির্মাণ করেন। ত্রেতা যুগে ‘স্বর্ণলঙ্কা’। দ্বাপর যুগে কৃষ্ণের কর্মভূমি দ্বারকা নগরী এবং কলি যুগে মহাভারতে বর্ণিত ইন্দ্রপ্রস্থ ও হস্তিনাপুর।
মুম্বইয়ে বেশ কয়েকটি ইন্ডাস্ট্রিতে বাঙালিদের ব্যবস্থাপনায় বিশ্বকর্মা পুজোর আয়োজন হয়। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা-সহ সমস্ত কর্মী, সাপ্লায়ার, এজেন্ট, মজদুর, ঠিকাদার সবাই একটা দিন হই হই করে পুজোয় সামিল হন। পুজো, ভোগ, খাওয়া-দাওয়া, আনন্দ সমেত সবেতন ছুটিটা উপভোগ করেন সমস্ত কর্মী।
মহালয়া হাতেগোনা ক’টা দিন পরই। বস্তুত ঢাকে কাঠি পড়া শুরু হয়ে গেছে গণেশ চতুর্থী থেকেই। বিশ্বকর্মা পুজো পার করেই দিন কয়েকের মধ্যেই চলে আসবে মহালয়ার ভোর। আকাশে বাতাসে পবিত্র ভোরের আলো ফোটার সন্ধিক্ষণে সুরের মূর্চ্ছনায় “বাজলো তোমার আলোর বেণু মাতলো রে ভুবন” নিদারুণ এক মন কেমন করা শূন্যতা চল্কে উঠবে বুকের ভেতর।
কানে ভেসে আসবে চিরকলীন বেতার ভাষ্য ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র অমর বেতার কথন। মহালয়ার সেই সমস্ত কোনও দিনও না পুরনো হওয়া প্রায় মুখস্থ গানগুলি। সেই যখন, মহালয়ার এক্কেবারে শুরুতেই ঘুম ঘুম চোখে জোর করে জাগিয়ে রাখা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অমোঘ কণ্ঠে “প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা....আশ্বিনের শারদোপ্রাতে বেজে উঠছে আলোকমঞ্জরী....”।
বাণীকুমার, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ত্রয়ীর সম্মিলিত সৃষ্ট মাতৃবন্দনা ও চণ্ডীপাঠের গূঢ় মূর্চ্ছনা। তখন একই সঙ্গে পুজো আসছে এমন এক আনন্দ অথচ মন কেমন করা শূন্যতার চোরা স্রোত হৃদয়ে মোচড় দিয়ে ওঠে। কেন কে জানে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মাতৃবন্দনার শ্রুতি-ভাষ্যে বর্ণিত টুকরো টুকরো পুরাণ কথার কোনও কোনও অং™ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের তেজ সৃষ্ট মহামায়া যাঁকে হিমালয় দিলেন দণ্ড, ব্রহ্মা দিলেন পবিত্র কুন্তল ও জপমালা, ইন্দ্র দিলেন বজ্র, কালদেব দিলেন খড়্গ, সূর্য দিলেন ধনুর্বান, চন্দ্র দিলেন অর্ধচন্দ্র, কুবের দিলেন চন্দ্রহার, বিশ্বকর্মা দিলের কবজ”।
নানান টুকরো পুরাণকথা ‘বিষ্ণুর যোগনিদ্রা’ কিংবা ‘মধু-কৈটভ’র দুবির্নীত আস্ফালন এমনই সব নাট্যকল্প। রামচন্দ্রের শরৎকালে অকালবোধনে এবং মেধস মণি তাঁর শিষ্যদের কাছে সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্য কর্তৃক দেবী দুর্গার মর্তে পুজো প্রচলনের কথা জানতে পারা যায়। তাঁদের যথাবিহিত পুজো স্তবস্তুতিতে প্রসন্ন হয়ে দেবী আবির্ভূতা হয়ে বরদান করতে চাইলেন, সুরথ রাজা তাঁর হৃত রাজ্য ও বৈভব ফিরে পেতে চাইলেন। এবং সমাধি বৈশ্য দেবীর কাছে বর চাইলেন মুক্তি। প্রসন্না দেবী দুর্গা দু’জনরই ইচ্ছা পূরণ করেন। আর সেই মাতৃস্তুতি
“যা দেবী সর্বভুতেষুু শক্তি রূপেণ সংস্থিতা
নমোস্তোসৈঃ নমোস্তোসৈঃ নমোস্তোসৈঃ নমঃ নমহা।”
‘ক্ষমা রূপেণ’, ‘শক্তি রূপেণ’, ‘শান্তি রূপেন’, ‘নিদ্রা রূপেণ’, ‘ভ্রান্তি রূপেণ’, ‘বিদ্যা রূপেণ’, ‘মাতৃ রূপেণ’ প্রভৃতি নানান স্বস্তিক ও তামসিক গুণের প্রকাশ দেবীর জগৎজননীর রূপে। আপাতত মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে “তব অচিন্ত্য রূপ শোভিত মহিমা” কিংবা সুপ্রীতি ঘোষের “বাজলো তোমার আলোর বেণু” কিংবা “নমো চণ্ডী নমো চণ্ডী” গানটির সঙ্গে সমবেত কণ্ঠে গীত “রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি” কী আর্তি, কী মাধুর্যের আশ্বাস। যেন কোনও বিশুদ্ধতার মোড়ক খুলে একটু একটু করে ফুটে ওঠা চিরন্তন।
আরও একবার জন্ম নাও হে দেবী দুর্গা। মৃন্ময়ী রূপ থেকে চিন্ময়ী রূপে। উদয় হোক শুভ চৈতন্যের। নারীর সম্মানকে অমর্যাদাকে দূর করো। জাগ্রত করো বিবেক ও মনুষ্যত্ব। অসুরতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জাগ্রত হোক।
ছবি: দেবাশিস ভাদুড়ি