আপাতত বাতিল গুজরাতের যৌথসভা

অণ্ণায় ধাক্কা খেয়ে এখন রাজ্যেই নজর মমতার

গত কাল রামলীলা ময়দানে টিম অণ্ণার সাংগঠনিক অদক্ষতার শিকার হওয়ার পরে দিল্লিতে তৃণমূলের দফতরের সামনে থেকে অণ্ণা হজারের সমস্ত ছবি সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ কলকাতা ফিরে যাওয়ার আগে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়কে মমতা নির্দেশ দেন, ১৮১, সাউথ অ্যাভিনিউয়ে তৃণমূলের দফতরের বাইরে অণ্ণার যত ছবি-পোস্টার রয়েছে, সব সরিয়ে ফেলতে হবে।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৪ ০৪:১৮
Share:

দিল্লি-ফেরত। বৃহস্পতিবার নবান্নে ঢোকার মুখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেবাশিস রায়ের তোলা ছবি।

গত কাল রামলীলা ময়দানে টিম অণ্ণার সাংগঠনিক অদক্ষতার শিকার হওয়ার পরে দিল্লিতে তৃণমূলের দফতরের সামনে থেকে অণ্ণা হজারের সমস্ত ছবি সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ কলকাতা ফিরে যাওয়ার আগে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়কে মমতা নির্দেশ দেন, ১৮১, সাউথ অ্যাভিনিউয়ে তৃণমূলের দফতরের বাইরে অণ্ণার যত ছবি-পোস্টার রয়েছে, সব সরিয়ে ফেলতে হবে। সেই মতো সন্ধের মধ্যেই ‘অণ্ণা-মুক্ত’ করা হয় তৃণমূল দফতর। যে দফতরে এসে গত মাসেই তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন অণ্ণা। অণ্ণার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে রামলীলার সভায় যোগ দিতে এসে গত দু’দিন ধরে এই বাড়িতেই ছিলেন মমতা।

Advertisement

তবে অণ্ণার ছবি-পোস্টার সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেও রাজনৈতিক পরিপক্কতার পরিচয় দিয়ে গত কালের মতো আজও ওই প্রবীণ নেতা সম্পর্কে কোনও বিরূপ মন্তব্য করেননি মমতা। সাংবাদিকেরা তাঁকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা সত্ত্বেও। তবে তিনি যে অণ্ণার উপরে রাজনৈতিক ভাবে নির্ভরশীল নন, বরং ঘটনাটা উল্টো, সেটাও কৌশলে বুঝিয়ে দিতে ছাড়েননি তৃণমূল নেত্রী। তিনি বলেন, “আমি অণ্ণা হজারেকে চিনতাম না। তিনি প্রবীণ মানুষ। আমাদের সাহায্য চাইতে তিনি নিজে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।” একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “অণ্ণার কোনও রাজনৈতিক দল নেই। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। আমরা তাঁকে সমর্থন করছি। মা-মাটি-মানুষের স্বার্থে আমাদের আন্দোলনকেও তিনি সমর্থন করছেন।” গত কালের ঘটনার পরে অণ্ণার সঙ্গে আর যোগাযোগও করেননি মমতা।

লোক টানার লড়াইয়ে অণ্ণা গত কাল তাঁর শিষ্য অরবিন্দ কেজরীবালের কাছে গো-হারা হারের ফলে ঘটনাচক্রে তৃণমূলের ভাবমূর্তি যে খানিকটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটা স্বীকার করছেন দলের অনেক নেতাই। মমতা নিজে অবশ্য এখন মনে করছেন, এই ঘটনায় আদতে তাঁর শাপে বরই হয়েছে। রামলীলায় অণ্ণার ফ্লপ শো থেকে শিক্ষা নিয়ে মমতা এখন লোকসভা ভোটে রাজ্যের ৪২টি আসনকেই পাখির চোখ করতে চাইছেন। কারণ তিনি জানেন, দেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে আসতে গেলে পশ্চিমবঙ্গ থেকেই তাঁকে সব থেকে বেশি আসন জিততে হবে। দিল্লি থেকে ফিরে কলকাতা বিমানবন্দরে তিনি বলেছেন, “ভারতে এখন দু’টো বড় রাজনৈতিক দল রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তারা লড়ছে। এ বার তৃণমূল দেশের তৃতীয় বড় দল হিসেবে উঠে আসবে।” সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য মমতা এখন জেলায় জেলায় সফর করবেন।

Advertisement

পাশাপাশি প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবেন ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, সিকিমের মতো প্রতিবেশী রাজ্যে। শুধু লোকসভা নির্বাচন নয়, ভবিষ্যতে ওই রাজ্যগুলির বিধানসভা নির্বাচনের দিকেও মমতার বিশেষ নজর রয়েছে।

খুলে ফেলা হয়েছে অণ্ণার পোস্টার। দিল্লিতে তৃণমূল
অফিসের সামনে। বৃহস্পতিবার প্রেম সিংহের তোলা ছবি।

গত কালের ঘটনার ময়না তদন্ত করে আরও কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। যার প্রথমটি হল, ‘টিম অণ্ণা’ চাইলেও দিল্লির সাতটি লোকসভা কেন্দ্রের সব ক’টিতে তৃণমূল প্রার্থী দেবে না। আসলে এই আসনগুলিতে অণ্ণা-ঘনিষ্ঠরাই লড়তে চাইছেন। কিন্তু অণ্ণার যে হেতু নিজের কোনও রাজনৈতিক দল নেই, সে হেতু তিনি তৃণমূলের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। তৃণমূলের বক্তব্য, দিল্লির মতো শহরে অণ্ণা যদি জনসভায় লোক জড়ো করতে না-পারেন এবং সে কথা স্বীকার না-করে তৃণমূলের ঘাড়ে দোষ চাপাতে ব্যস্ত থাকেন, তা হলে অণ্ণা মনোনীত প্রার্থীদের তারাই বা কেন টিকিট দেবে? এই কারণে দক্ষিণ দিল্লি কেন্দ্রে অভিনেতা বিশ্বজিৎ ছাড়া দিল্লির অন্য কোনও আসনে তৃণমূল প্রার্থী দেয়নি। অণ্ণাই ওই আসনগুলিতে প্রার্থী বাছাই করবেন বলে প্রথম জানানো হয়েছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তৃণমূল অণ্ণার প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে চাইছে না। অণ্ণার প্রতিনিধি সন্তোষ ভারতী আজ মুকুল রায়ের সঙ্গে দেখা করে বাকি নামগুলি ঘোষণার জন্য দরবার করলেও সে পথে হাঁটেননি তৃণমূল নেতৃত্ব।

দ্বিতীয়ত, আগামী ২০ মার্চ আমদাবাদে অণ্ণাকে সঙ্গে নিয়ে মমতার যে যৌথসভার পরিকল্পনা ছিল, আপাতত তা বাতিল করা হয়েছে। ভবিষ্যতে অণ্ণার সঙ্গে মমতার যৌথসভা হওয়ার সম্ভাবনাও কম।

আমি অণ্ণা হজারেকে চিনতাম না। তিনি প্রবীণ মানুষ।
আমাদের সাহায্য চাইতে তিনি নিজে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

তবে অণ্ণার মতো এক জন ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে না গিয়ে বরং হিসেব কষেই চলতে চাইছে তৃণমূল। পাশাপাশি অণ্ণাও এখনও পর্যন্ত কোনও বিবৃতি দেননি। তবে সভায় লোক না-হওয়ার জন্য ‘টিম অণ্ণা’র পক্ষ থেকে যে ভাবে পরোক্ষে তৃণমূলকে দায়ী করা হচ্ছে, তাতে দলীয় নেতারা ক্ষুব্ধ। বস্তুত, এ বার দিল্লি এসেই রামলীলা ময়দানে সভা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন মমতা। তাঁর বক্তব্য ছিল, তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোক আনছে না। অন্য কোনও রাজ্য থেকে ভোটের সময় জোর করে লোক ধরে আনাটাও ঠিক নয় বলেই মনে করেন মমতা। তাই এই সভা তালকাটোরা স্টেডিয়ামের মতো রুদ্ধদ্বার প্রেক্ষাগৃহে করলেই ভাল হতো।

তৃণমূলের অনেকের সন্দেহ, গত কাল অণ্ণাকে রামলীলা ময়দানে যেতে নিরস্ত করার পিছনে বিজেপি-র জনা কয়েক নেতা রয়েছেন। এমনকী বিজেপি-র কিছু নেতা নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে অণ্ণার বৈঠক করানোরও পরিকল্পনা করছেন। আবার অনেকে মমতার কাছে এসে বলেছেন, অভিষেক মনু সিঙ্ঘভির মতো কংগ্রেস নেতা অণ্ণার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। কংগ্রেসও এর পিছনে থাকতে পারে। কলকাতা ফেরার আগে তৃণমূলের নেতাদের মমতা বলেছেন, “প্রমাণ ছাড়া কারও সম্পর্কেই কিছু বলতে চাই না। দিল্লিকে ষড়যন্ত্রনগরী বলে। আমি কিন্তু ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। আমার যা উদ্দেশ্য, তা স্পষ্ট ভাবে বলেছি। ভবিষ্যতেও বলব।”

কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, রাজ্য রাজনীতিতে সফল হলেও মমতা কি দিল্লির রাজনীতিতে ব্যর্থ হচ্ছেন? রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় মুলায়ম সিংহের কাছে, ফেডেরাল ফ্রন্ট গঠনের প্রশ্নে প্রকাশ কারাটের কাছে আর এ বার অণ্ণা হজারের ফাঁদে পা-দিয়ে তিনি অসফল হলেন। এ প্রশ্নের জবাবে মুকুল রায় বলেন, “আসন্ন নির্বাচনের ফলাফলই বলে দেবে কে ব্যর্থ আর কে সফল?”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement