হরকিষেণ সিংহ সুরজিতের জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য সীতারাম ইয়েচুরির। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।
পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত লাইনে লক্ষ্মণরেখা টানা আছে। আবার তাকে অতিক্রম করার জন্য প্রয়াত হরকিষেণ সিংহ সুরজিতের দৃষ্টান্তও আছে! বিধানসভা ভোটের আগে এ রাজ্যে বাম ও কংগ্রেসের কাছাকাছি আসা নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে যখন প্রবল চর্চা, সেই সময়ে দ্বিতীয় দৃষ্টান্তকেই কৌশলে ব্যবহার করলেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি!
দলের প্রয়াত প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক সুরজিতের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে রবিবার মুখ্য বক্তা ছিলেন বর্তমান সাধারণ সম্পাদক। মনমোহন সিংহকে প্রধানমন্ত্রী করে এবং সনিয়া গাঁধীকে চেয়ারপার্সন করে ১১ বছর আগে ইউপিএ-১ গড়ে ওঠার ইতিহাস এখনও ফিকে হয়নি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জল্পনা উস্কে দিয়ে সেই ইতিহাসই ফের সামনে এনেছেন ইয়েচুরি। তাঁর বক্তব্য, কমিউনিস্ট পার্টিকে একই সঙ্গে দুই কৌশল নিয়ে চলতে হয়। এক দিকে নিজেদের স্বাধীন শক্তি বাড়াতে হয় এবং অন্য দিকে প্রতিপক্ষের শক্তি খর্ব করার চেষ্টা করতে হয়। এই কাজটাই অনায়াস দক্ষতায় করতেন সুরজিৎ। তিনি বুঝেছিলেন, সাম্প্রদায়িকতা ভয়ঙ্কর বিপদ। তাই কংগ্রেসের হাতে মাত্র ১৪৫ জন সাংসদ আছে জেনেও ২০০৪ সালে ধর্মনিরপেক্ষ সব শক্তিকে একজোট করার জন্য ঝাঁপিয়েছিলেন শুধু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ঠেকানোর জন্য। এবং তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ইয়েচুরি মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি, ‘‘ভুললে চলবে না, নরেন্দ্র মোদী এবং আরএসএসের হাত ধরে সাম্প্রদায়িক শক্তি এখন আবার বিষ ছড়াচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শিথিলতা আসা মানেই গণতন্ত্রের কাঠামোও দুর্বল হয়ে পড়া।’’
সল্টলেকের পূর্বশ্রী প্রেক্ষাগৃহে ইয়েচুরি যখন এ কথা বলছেন, বিধাননগরের ভোট-বাজার তখন সরগরম! সিপিএম এবং কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গেই এলাকার বিশিষ্ট জনেদের নিয়ে বিধাননগরে গড়ে উঠেছে ‘সল্টলেক সিটি়জেন্স ফোরাম’। তৃণমূলের ‘সন্ত্রাস’ মোকাবিলার লক্ষ্যে এই মঞ্চ গঠিত হলেও তারা নিয়মিত প্রচারে থাকবে এবং তাদের থেকে তাঁরা পরামর্শ নেবেন বলে এ দিনই জানিয়েছেন সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেব। এই ধরনের মঞ্চই ভবিষ্যতে বাম-কংগ্রেসকে আরও নিকটে আনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে কি না, এই তুঙ্গ জল্পনার মাঝেই ইয়েচুরির কৌশলী ইতিহাস বর্ণনা ভিন্ন তাৎপর্য বয়ে আনছে বৈকি!
ইয়েচুরি এ দিন বলেন, ‘‘সে বার আমাদের ৬১ জন সাংসদ ছিলেন। তার মধ্যে বহু সাংসদই ভোটে জিতেছিলেন সরাসরি কংগ্রেসকে হারিয়ে। তার পরেও কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারকে কেন্দ্রে সমর্থন করেছিল বামপন্থীরা। তার ফলে এক দিকে যেমন জাতীয় রাজনীতিতে বামেদের গুরুত্ব বাড়ানোর লক্ষ্য সফল হয়েছিল, তেমনই আবার গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা বা খাদ্যের অধিকারের মতো সামাজিক প্রকল্প বাস্তবায়িত করা গিয়েছিল অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির মাধ্যমে।’’ কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের বৈরিতা কি সুরজিৎ জানতেন না? তা সত্ত্বেও তিনি এমন কাজে পৌরোহিত্য করেছিলেন কেন? ইয়েচুরির কথায়, ‘‘তিনি বুঝেছিলেন, সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে কোনও আপস চলে না।’’
বস্তুত, প্রথমে শিলিগুড়ি এবং অধুনা বিধাননগরের ঘটনাপ্রবাহে বাম শিবিরের একাংশের মধ্যেও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। বামেদের ১৭ দলের জোটের অন্যতম শরিক সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ এ দিনও জানতে চেয়েছেন, এক শ্রেণির নেতারা কেন কোনও না কোনও অছিলায় কংগ্রেসের কাছাকাছি গিয়ে বাম ঐক্যের সঙ্গে অন্তর্ঘাত করতে চাইছেন? এ ব্যাপারে সিপিএম নেতৃত্বের ব্যাখ্যাও দাবি করেছেন তিনি। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অশোক ভট্টাচার্য এ দিনই ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘‘তথাকথিত শিলিগুড়ি মডেলের নামে যা বলা হচ্ছে, সেটা একেবারেই ঠিক নয়! আমরা কোনও ভাবেই কংগ্রেস বা বিজেপি-র সঙ্গে কোনও নির্বাচনী সমঝোতা করিনি। মানুষ ভোট যাদেরই দিন, যাতে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, তার জন্য শিলিগুড়িতে সকলকে একজোট করেছি মাত্র। বিধাননগরেও সেটাই হচ্ছে।’’
কিন্তু এর পরেও ইয়েচুরির এ দিনের বক্তৃতা তো বামেদের একাংশে আতঙ্ক ছড়াতে পারে! ধুরন্ধর ইয়েচুরি সে আশঙ্কা আঁচ করেই অনুষ্ঠানের পরে ব্যাখ্যা দিয়ে দিয়েছেন, ‘‘কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও নির্বাচনী জোট করার কথা বলিনি। মোদীর সাম্প্রদায়িকতা আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বৈরতন্ত্রের মোকাবিলায় আমরা চাই মানুষের জোট। সেটা গড়ে উঠলে সকলে সব উত্তর পেয়ে যাবেন!’’