ফাইল চিত্র।
টিভিতে খবরটা দেখেই চমকে উঠেছিলেন দিদি। তামিলনাড়ুর সুলুর বায়ুসেনা ঘাঁটি থেকে ওড়ার কিছু ক্ষণের মধ্যে কুন্নুরের কাছে ভেঙে পড়েছে দেশের প্রথম চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়তের হেলিপক্টার। ওই বায়ুসেনা ঘাঁটিতেই তো কর্মরত তাঁর পাইলট ভাইটি। তখনও দুর্ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য আসেনি সংবাদমাধ্যমে। ভাইয়ের ফোন বন্ধ পেয়ে ফোন করলেন তাঁর স্ত্রী কামিনীকে। জানতে পারলেন, আদরের ছোট ভাই উইং কমান্ডার পৃথ্বী সিংহ চৌহানই ছিলেন এ দিনের ভেঙে পড়া কপ্টারের দুই চালকের এক জন।
গত কালের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় সিডিএস বিপিন রাওয়ত, তাঁর স্ত্রী মধুলিকা ছাড়া প্রাণ হারিয়েছেন আরও ১১ জন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মধ্যপ্রদেশের বাসিন্দা উইং কমান্ডার পৃথ্বী। সেনার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০০০ সালে যোগ দেন হায়দরাবাদের বায়ুসেনা বাহিনীতে। বর্তমানে কোয়ম্বত্তূরে কর্মরত ছিলেন। ২০০৬ সাল নাগাদ আগরায় চলে আসে পৃথ্বীর পরিবার। তার পরের বছর বিয়ে। ১২ বছরের মেয়ে আর ৭ বছরের ছেলেকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল পৃথ্বী-কামিনীর। ৭৪ বছরের বৃদ্ধ বাবা সুরেন্দ্র সিংহ জানালেন, পাঁচ ছেলেমেয়ের সবচেয়ে ছোট পৃথ্বী যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন রাখির সময় বাড়ি ফিরতেনই। ক’দিন ধরে মায়ের চোখে কিছু সমস্যা হচ্ছিল। সেনা হাসপাতালে মায়ের চোখ দেখানো নিয়েই দিন কয়েক আগে শেষ বার ছেলের সঙ্গে কথা হয় সুরেন্দ্রের। জানুয়ারিতে বাড়ি ফেরার কথা ছিল তাঁর।
মারা গিয়েছেন কপ্টারের আর এক পাইলট স্কোয়াড্রন লিডার কে সিংহ, বায়ুসেনার দুই অফিসার রানা প্রতাপ দাস এবং প্রদীপ এ। জুনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার রানা প্রতাপ দাস ওড়িশার তালচেরের বাসিন্দা। ১২ বছর ধরে তিনি বায়ুসেনায় কর্মরত। তাঁর স্ত্রী পেশায় চিকিৎসক। রয়েছে এক বছরের পুত্রসন্তান। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান তাঁর মৃত্যুতে টুইট করে জানিয়েছেন, ভীষণই মার্জিত স্বভাবের মানুষ ছিলেন ওড়িশার এই ‘দামাল ছেলে’। প্রদীপ এ কেরলের ত্রিশূরের বাসিন্দা। ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদী দমন অভিযান ও বন্যায় দুর্গতদের উদ্ধারের কাজে তাঁর অবদান ভোলার নয়।
কাল রাওয়ত দম্পতির সঙ্গে ছিলেন সিডিএস দফতরের দুই শীর্ষকর্তা— ব্রিগেডিয়ার লখবিন্দর সিংহ লিড্ডার এবং কর্নেল হরজিন্দর সিংহ। হরিয়ানার পঞ্চকুলার বাসিন্দা লিড্ডারেরা। সেক্টর বারোর ৩৫৭ নম্বর বাড়িটায় এখন যদিও কেউ থাকেন না। তবু মাঝে মাঝেই পঞ্চকুলার বাড়ি থেকে ঘুরে যেতেন ব্রিগেডিয়ার। সেই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশী কর্নেল ভূপেন্দ্র সিংহ বললেন, ‘‘মাস দেড়েক আগে লিড্ডার শেষ বার যখন এলেন তখন আমাদের কথা হয়েছিল। ২০ বছরের বন্ধুত্ব। অমায়িক লোক ছিলেন উনি।’’ খুব তাড়াতাড়ি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হওয়ার কথা ছিল লিড্ডারের। সব প্রস্তুতি সারা হয়ে গিয়েছিল। জম্মু-কাশ্মীর রাইফেলসে এর আগে কাজ করেছেন। কাজ়াখস্থানে ভারতের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত আধিকারিক হিসাবে যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব সামলেছেন। সন্ত্রাস দমনে তাঁর ভূমিকা উপর মহলে বিশেষ প্রশংসিত হয়েছিল।
কর্নেল হরজিন্দর সিংহ সিডিএস রাওয়তের মতোই ১১ গোর্খা রাইফেলসে কর্তব্যরত ছিলেন। লখনউয়ের বাসিন্দা হরজিন্দর সিয়াচেন সংঘাত থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তি মিশন— বহু ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন।
গত কাল মারা গিয়েছেন পাঁচ নিরাপত্তা কর্মীও। দার্জিলিঙের তাকদার বাসিন্দা হাবিলদার সৎপাল রাই (৪১) ছিলেন বিপিন রাওয়তের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী।
নায়েক গুরসেবক সিংহ তিন বছর ধরে সিডিএস-এ কর্মরত ছিলেন। বাড়িতে স্ত্রী আর তিন নাবালক সন্তান রয়েছে তাঁর। গুরসেবকের ভাই গুরুবখস্ বললেন, ‘‘দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি এমনটা হবে। আগের রাতেই আমাদের সঙ্গে কথা হল। আর আজ সব শেষ।’’
বাকিরা হলেন মধ্যপ্রদেশের বাসিন্দা নায়েক জিতেন্দ্র কুমার, ল্যান্স নায়েক বিবেক কুমার এবং ল্যান্স নায়েক বি তেজা সাই। ২৭ বছরের তেজার বাড়ি অন্ধ্রপ্রদেশের চিত্তোরে। কৃষক পরিবারের সন্তান তেজা ২০১৩ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। হেলিকপ্টার ভেঙে পড়ার মাত্র চার ঘণ্টা আগেই ভিডিয়ো কলে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন তেজা। স্বামীর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে পাঁচ আর দুই বছরের সন্তানদের কোলে নিয়ে বাড়ির দাওয়ায় পাথরের মতো বসেছিলেন স্ত্রী শ্যামলী। তেজার ছোট ভাই বি মহেশও রয়েছেন সেনাবাহিনীতে। তেজাকে হারিয়ে মহেশকেই এ বার আগলে রাখতে চায় পরিবার। সংবাদ সংস্থা