ভাগ্যিস ‘ভগবান’ চিরনিদ্রায় গিয়েছেন!
না হলে যে কী হত!
ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে তির-ধনুক হাতে তুলে নেওয়ার সময় ‘বিজলি’ যে কী, তা জানতেন না বিরসা মুণ্ডা। কিন্তু, এটাও তো জানতেন না যে তাঁর মৃত্যুর দীর্ঘ ১২৫ বছর পরেও সেই ‘বিজলি-সড়ক-পানি’র লড়াইটাই লড়তে হচ্ছে তাঁর ও লড়াইয়ের ময়দানে তাঁর সতীর্থদের উত্তরপুরুষকে!
খুটি শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূর সাইকো মোড় হয়ে উলিহাতু গ্রামে না পৌঁছলে আরও কত কিছুই যে অজানা থেকে যেত!
রাজ্যের প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে উৎসবে মেতেছে ঝাড়খণ্ড। কোটি কোটি টাকার নানা প্রকল্পের ঘোষণা হচ্ছে। অথচ, ঝাড়খণ্ডের ‘ভগবান’ বিরসা মুণ্ডার গ্রাম উলিহাতুতেই পৌঁছয়নি উন্নয়নের আলো।
বিরসা মুণ্ডার গ্রাম উলিহাতু তাঁর জন্মভূমি। অথচ বিরসার সেই পবিত্র জন্মভূমির গ্রামে শৌচালয় থেকে শুরু করে ন্যুনতম পরিষেবা পর্যন্ত নেই। তাই ১৫ নভেম্বর, রবিবার ঝাড়খণ্ডের প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে উৎসবের বিপুল আয়োজনের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য যে রাজ্য তৈরি হল, সেই রাজ্যে আদিবাসীদের উন্নয়ন সত্যিই কতটা হল? আদৌ হল কি?
প্রশ্নের উত্তরটাও পাওয়া গেল অচিরেই।
উলিহাতু যাওয়ার ভিড়ে ঠাসা ট্রেকারের হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে বাজার থেকে ফিরছিলেন কয়েক জন আদিবাসী মহিলা। যাত্রীদের হাতে বাজারের ব্যাগ। পরের ট্রেকারে আসছেন না কেন? প্রশ্নটা শোনা মাত্রই ট্রেকারের পাশের যাত্রী প্রায় খেঁকিয়ে বলেন, ‘‘পরের ট্রেকার আর নেই। এই ট্রেকার না পেলে ব্যাগ নিয়ে বাজারেই রাত কাটাতে হবে।’’ সাইকো মোড় থেকে উলিহাতু যাওয়ার পাহাড় ও জঙ্গল ঘেরা রাস্তায় মাওবাদীদের ভয়ে দিনের বেলাতেও খুব প্রয়োজন না হলে হেঁটে যেতে সাহস করেন না গ্রামবাসীরা।
গ্রামবাসী রয়ান পুর্তি-র কথায়: ‘‘কারও অসুখ করলে অসুস্থ রোগীকে ঘাড়ে করে অথবা সাইকেলে চাপিয়ে ১০ কিলোমিটার দূরে আরকি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা খুটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হয়। গত পনেরো বছর ধরে সকাল-বিকেল একটা ট্রেকারই আমাদের ভরসা।’’
গ্রামে উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি হয়েছে বলে রঘুবর দাস সরকার ঘোষণা করেছিলেন। গ্রামের ধার ঘেঁষা ওই উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল ওটা একটা পরিত্যক্ত বাড়ি। যুথি পুর্তি নামে বছর চল্লিশের এক মহিলা বলেন, ‘‘সরকার থেকে বলল, শৌচালয় তাড়াতাড়ি তৈরি করে দেওয়া হবে। কিন্তু এখনও একটাও শৌচালয় তৈরি হয়নি।’’
বিরসা মুণ্ডার গ্রামে শৌচালয় নেই। স্কুল আছে, কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষিকা কার্যত নেই। গ্রামে পানীয় জলের তীব্র সমস্যা। সরকার থেকে মাসখানেক আগে থেকে পাইপলাইনে জল দিচ্ছে ঠিকই তবে তা খাওয়ার উপযুক্ত নয়। দূরের কুঁয়ো থেকে পানীয় জল আনতে হয়। গ্রামের রাস্তায় সৌরবিদ্যুতের আলো রয়েছে নামেই। মাসে ১০ থেকে ১৫ দিন বিদ্যুৎ থাকলেই গ্রামবাসীরা নিজেদের ভাগ্যবান বলে মনে করেন।
এর মধ্যেই অবশ্য পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে নেমেছেন ভোটপ্রার্থীরা। যে গ্রামে সারা মাসে দিন দশেক মাত্র বিদ্যুৎ থাকে, সেখানে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের প্রতীক নিয়ে লড়ছেন এক প্রার্থী! তবুও সুমন পুর্তি নামে এক প্রার্থীর আশ্বাস: ‘‘গ্রামের হাল আমরা ফেরাবই।’’
কিন্তু হাল কি আদৌ ফিরবে? গত ১৫ বছরে ১০ বার সরকার বদলেছে। ছ’জন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। অথচ, আদিবাসীদের হাল ফেরেনি। ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের সঙ্গে গোড়া থেকে যুক্ত সমাজকর্মী বাসবী কিরো বলেন, ‘‘অন্যান্য আদিবাসী গ্রামের মতো উলিহাতু-র বাসিন্দারাও অপুষ্টিতে ভুগছেন। উলিহাতু-র বাসিন্দারা ম্যালেরিয়া ও অ্যানিমিয়ার শিকার। বিজেপি সরকার বা ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা— কেউই আদিবাসীদের জন্য কিছু করেনি।’’ ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা-র সাধারণ সম্পাদক সুপ্রিয় ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘গত পনেরো বছরে বিজেপি সরকারই বেশি বছর ছিল। আমরা যেটুকু সময় পেয়েছি আদিবাসীদের জন্য উন্নয়নই করেছি।’’ যদিও বর্তমান বিজেপি-র রঘুবর দাস সরকারের স্বরাষ্ট্রসচিব এন এন পাণ্ডে-র দাবি, ‘‘আগের তুলনায় বিরসা মুণ্ডার গ্রামের হাল ফিরছে অনেকটাই। আমরা উন্নয়নের প্রচুর পরিকল্পনা নিয়েছি। শুধু শহর নয়, শহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আদিবাসীদের গ্রামেরও উন্নয়ন হবে।’’
‘স্বচ্ছ ভারত’-এর অংশীদার হতে পারেনি উলিহাতু। গ্রামে এখনও একটিও শৌচাগার নেই!
তা হলে ‘অচ্ছে দিন’ কি কখনও আসবে না? ভারত জুড়ে ‘অচ্ছে দিন’-এর ঢক্কানিনাদ এই উলিহাতু পর্যন্ত পৌঁছবে না?
চিরনিদ্রায় গিয়েছেন ‘ভগবান বিরসা’। উত্তরটা দেয় কে?