সাংহাই কো-অপারেশন অরগানাইজ়েশন। সংক্ষেপে এসসিও। মূলত এশিয়া এবং ইউরোপের কিছু দেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক এই সংগঠন গঠিত। ইউরোপ এবং এশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা বিষয়ক আলোচনার জন্য প্রতি বছর এসসিও-র সদস্য দেশগুলি মিলিত হয়।
২০০১ সালে চিন এবং রাশিয়ার উদ্যোগে এসসিও গঠিত হয়েছিল। বর্তমানে এই আন্তর্জাতিক সংগঠনটিতে মোট ১০টি পূর্ণ সদস্য রয়েছে। তারা হল ভারত, পাকিস্তান, ইরান, বেলারুস, চিন, কাজ়াখস্তান, কিরঘিস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান এবং উজ়বেকিস্তান।
২০২৪ সালের এসসিও সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছিল কাজ়াখস্তানে। গত ৩ এবং ৪ জুলাই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সদস্য দেশগুলির প্রতিনিধিরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। একাধিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানও হাজির হয়েছিলেন।
ভারত থেকে এসসিও সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। আমন্ত্রণ পেলেও কাজ়াখস্তানে যাননি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
সরকারি ভাবে মোদীর কাজ়াখস্তানে না যাওয়ার কারণ হিসাবে নয়াদিল্লির তরফে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, ওই সময়ে ভারতের সংসদে অধিবেশন চলছিল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মোদী। সেই কারণে নাকি ইচ্ছা থাকলেও এসসিও-র বৈঠকে তিনি যোগ দিতে পারেননি।
বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, মোদীর কাজ়াখস্তানে না যাওয়ার আসল কারণ ভিন্ন। এর নেপথ্যে রয়েছে নয়াদিল্লির বিশেষ বিদেশ নীতি। নানা ধরনের কূটনৈতিক ভাবনা কাজ করেছে এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে।
অনেকে বলছেন, মোদীর কাজ়াখস্তানে না যাওয়ার নেপথ্যে অন্যতম কারণ চিনকে এড়ানো। চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে এড়িয়ে চলাকে এই মুহূর্তে ভারতের বিদেশ নীতির অন্যতম অঙ্গ বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
২০২০ সালে গালওয়ান সীমান্তে চিনের সঙ্গে সংঘর্ষের পর বেজিং-দিল্লি সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। তার পর থেকে এখনও পর্যন্ত এই দুই দেশের সম্পর্ক মসৃণ হয়নি। কিছু দিন আগে ভারতে আয়োজিত জি২০ সম্মেলনেও আমন্ত্রিত ছিলেন জিনপিং। কিন্তু তিনি আসেননি।
এসসিও নামক এই আন্তর্জাতিক সংগঠন বিশ্ব রাজনীতিতে খানিক পশ্চিমবিরোধী হিসাবে পরিচিত। সরাসরি এই বৈঠকে মোদী যোগ দিলে তাতে আমেরিকা রুষ্ট হতে পারত বলে মনে করছেন অনেকে। সেই কারণেও বৈঠক এড়িয়ে থাকতে পারেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু অনেকে এই যুক্তি উড়িয়ে দিচ্ছেন। কারণ এসসিও বৈঠকের ঠিক পরে রাশিয়ায় দু’দিনের সফরে গিয়েছেন মোদী স্বয়ং। রাশিয়া এবং আমেরিকার আদায় কাঁচকলায় সম্পর্কের কথা কারও অবিদিত নয়।
সে ক্ষেত্রে, জিনপিংকে এড়ানোর প্রসঙ্গেই আপাতত জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের বৈঠকে মোদী এবং জিনপিংয়ের সাক্ষাৎ হয়নি। ২০২২ সালের এসসিও সম্মেলনে মোদী এবং জিনপিং দু’জনেই উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু কেউ কারও মুখোমুখি হননি।
বিশেষজ্ঞদের একাংশ এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের কথাও বলছেন। তাঁদের বক্তব্য, পাকিস্তানকেও এড়াতে চান মোদী। কারণ, গত কয়েক বছরে পাক হামলায় বার বার অশান্ত হয়ে উঠেছে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত। জঙ্গি হামলার ঘটনাও বেড়ে গিয়েছে। ভারতের দাবি, পাকিস্তানের মদতেই হামলা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের মুখোমুখি হতে চাইছেন না মোদী।
কেউ কেউ মোদীর এসসিও-তে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভারতে সদ্য শেষ হওয়া লোকসভা ভোটের ফলাফলের যোগও পাচ্ছেন। তাঁদের মতে, লোকসভায় বিজেপির অবস্থান খুব মজবুত নয়। তার মাঝে চিন নিয়ন্ত্রিত এসসিও বৈঠকে গেলে বিরোধীরা সমালোচনা করার সুযোগ পেয়ে যাবে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও রাশিয়ায় কেন গেলেন মোদী? চিন এবং রাশিয়ার মধ্যে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। আমেরিকার বিরোধী রাষ্ট্রে গিয়ে কী বার্তা দিতে চাইলেন তিনি?
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, রাশিয়ায় গিয়ে পুতিনের সঙ্গে দেখা করে আসলে আমেরিকা এবং চিন, উভয়কেই বার্তা দিতে চাইল ভারত। সেই বার্তার জন্য রাশিয়ার চেয়ে ভাল বিকল্প আর ছিল না মোদীর হাতে। তাই এই সফর জরুরি ছিল।
ইউক্রেন যুদ্ধের পর চিনের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া সফরে গিয়ে মোদীও ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখতে চাইলেন। সেই সঙ্গে চিনকে বার্তা দিতে চাইলেন, তারা ছাড়াও রাশিয়ার অন্য বন্ধু রয়েছে।
পন্নুন মামলায় ভারতের উপর যখন লাগাতার চাপ বৃদ্ধি করছিল আমেরিকা, সেই সময়ে মোদীর রাশিয়া সফর পশ্চিমকেও পাল্টা বার্তা দিচ্ছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। এই সফর ভারতের চিরাচরিত নিরপেক্ষ এবং পূর্ব-পশ্চিম ভারসাম্যের অবস্থানকেই আরও দৃঢ় করেছে।
ভারত এবং চিনের কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েনের মাঝে রাশিয়ার অবস্থান নিরপেক্ষ। অনেকের মতে, সেই অবস্থান আরও বেশি করে নিশ্চিত করতেই মোদীর এই রাশিয়া সফর। চিনের চাপে রাশিয়া যাতে ভবিষ্যতে ভারতের বিরুদ্ধে না যায়, তা নিশ্চিত করতে চান মোদী।
এই সমস্ত কারণেই এসসিও বৈঠক এড়ানো এবং তার পরেই রাশিয়া সফরে যাওয়ার যে সিদ্ধান্ত মোদী নিয়েছেন, তা ভূ-রাজনীতির দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আগামী দিনে ভারতের এই পরিবর্তিত বিদেশ নীতি কাজে লাগে কি না, সেটাই দেখার।