Tripura Assembly Election 2018

হাওয়ায় নয়, সিপিএম বধের পিছনে গবেষণা ছিল বিস্তর

সকালটা শুরু হয়েছিল অন্য ভাবে। আগরতলা শহরের উমাকান্ত অ্যাকাডেমিতে শুরু হয়েছিল ত্রিপুরা পশ্চিম জেলার ১৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটগণনা। ভোর থেকেই সেখানে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের ভিড়।

Advertisement

তাপস সিংহ

আগরতলা শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৮ ২০:৫৪
Share:

জয়ের পর বিজেপি সমর্থকদের উল্লাস। শনিবার আগরতলায়। ছবি: রয়টার্স।

যে গেরুয়া রং মানুষকে সর্বত্যাগী করে পার্থিব তুচ্ছাতিতুচ্ছ চাহিদা ত্যাগের শিক্ষা দেয়, সেই গেরুয়াই এ ভাবে ঝড় তুলে ক্ষমতার স্বাদ দেওয়ায়!

Advertisement

বিজেপির রাজ্য সদর দফতরের দোতলার হল ঘরে তখন গেরুয়া আবিরের ঝড়। ‘জয় ভারতমাতা কী’ জয়ধ্বনিতে কান পাতা দায়। পটকার অবিরাম শব্দক্ষরণ। মুখে গেরুয়া আবির মেখে বিজেপির রাজ্য সভাপতি বিপ্লব কুমার দেব যখন সাংবাদিক সম্মেলনে এলেন মুখটা কেমন লাজুক লাজুক লাগল। তাঁর সঙ্গে একই মঞ্চে তখন বিজেপির ত্রিপুরার ভারপ্রাপ্ত নেতা সুনীল দেওধর, দলীয় নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মা ও জাতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা উত্তর-পূর্বের ভারপ্রাপ্ত নেতা রাম মাধব।

অবধারিত সেই প্রশ্নটা ধেয়ে এল প্রথমে রাম মাধবের দিকে। কে হচ্ছেন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী? বিপ্লব কুমার দেব? প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে রাম মাধব বললেন, আজ দিল্লিতে দলের সংসদীয় বোর্ডের বৈঠক আছে। সেখানে যা ঠিক হওয়ার হবে। ঠিক একই প্রশ্ন যখন বিপ্লবের উদ্দেশে ছুড়ে দেওয়া হল, লাজুক হেসে বিপ্লব বললেন, ‘‘দল যা ঠিক করবে, হবে।’’

Advertisement

অথচ, সকালটা শুরু হয়েছিল অন্য ভাবে। আগরতলা শহরের উমাকান্ত অ্যাকাডেমিতে শুরু হয়েছিল ত্রিপুরা পশ্চিম জেলার ১৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটগণনা। ভোর থেকেই সেখানে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের ভিড়। মাথায় লাল টুপি, গায়ে লাল গেঞ্জি। কারও বা মাথায় ফেট্টি। দলে দলে গণনা কেন্দ্রের বাইরে দলীয় সমর্থকদের ভিড়। এসেছেন বহু মহিলাও। বিজেপি সমর্থকদের ভিড়টাকে পুলিশ সরিয়ে দিয়েছে আরএমএস চৌমোহনীর দিকে। সেই ভিড়ের চেহারাটা আবার অন্য। সেখানে বিজেপির নির্বাচনী সহযোগী আইপিএফটি-র (ইন্ডিজেনাস পিপল’স ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা) সমর্থকেরা দলে ভারী। বিজেপি এবং আইপিএফটি-র পতাকায় ছেয়ে গিয়েছে এলাকা। কী হবে এ বার? ভিড়ের মুখ চন্দ্রকেতু দেববর্মা বললেন, ‘‘কী আবার হবে? আমরাই আসছি।’’ মুখে-চোখে আত্মবিশ্বাস।

এ বাবের ফলাফল এখনও চূড়ান্ত নয়।

যে আত্মবিশ্বাসটা বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে যেন উধাও হয়ে যাচ্ছিল সিপিএম সমর্থকদের চোখ-মুখ থেকে। এক একটি রাউন্ডের গণনা এগিয়েছে আর ভিড়টা ইতস্তত ছড়িয়ে গিয়েছে। উমাকান্ত অ্যাকাডেমির এক প্রান্তে যখন হতাশা গ্রাস করছে, তখন অন্য প্রান্তে বিজেপি সমর্থকদের জয়োল্লাস। এ রকম জয়, এতটা ব্যবধানে সিকি শতকের একটা দলকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা যেতে পারে, এমনটা কি কট্টর বিজেপি সমর্থকও ভেবেছিলেন?

বিজেপি নেতৃত্ব বলছেন, এমনটা তাঁরা আশা করেছিলেন। এই সাফল্যের কয়েকটি ‘রেসিপি’ দিনভর ঘুরে উদ্ধারও করা গিয়েছে।

১) তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত ২০টি আসনের মধ্যে বিজেপি ও সহযোগী দলের ঝুলিতে গিয়েছে ১৯টিই। প্রত্যাশার থেকেও বেশি।

২) বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের লাগাতার ত্রিপুরা সফর রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের উপরেও পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করেছিল। এতে নিচুতলার বিজেপি কর্মী-সমর্থকেরা বাড়তি মনোবল পান।

আরও পড়ুন: গেরুয়া ঝড়, মানিক বদলে ‘হিরা’কেই বাছল ত্রিপুরা

৩) দিনের পর দিন বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বেতন না পেয়ে রাজ্য সরকারি কর্মীরা এমনিতেই ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁদের সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজেপি পালের হাওয়া কেড়েছে সিপিএমের।

৪) সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ১০ হাজার ৩২৩ জন শিক্ষকের চাকরি চলে যাওয়ার হতাশা বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে। বিজেপি এই ক্ষোভকেও নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসে।

৫) মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি তুলে ধরলেও স্থানীয় স্তরে অনেক সিপিএম নেতা-কর্মীর চালচলন বা জীবনযাত্রা অনেকের চোখেই ভাল ঠেকেনি।

৬) বিজেপির পক্ষে ত্রিপুরার ভারপ্রাপ্ত সুনীল দেওধর আনন্দবাজার ডিজিটালকে বলেছিলেন, সিপিএমকে হারাতে হলে বুথ জিততে হবে। আর সেই কাজটাই তিনি গত দু’বছর ধরে কার্যত চুপচাপ করে গিয়েছেন। ত্রিপুরা জুড়ে নিয়োগ করেছেন ৮৫ জন বিস্তারক। ৬০টি বিধানসভা কেন্দ্রের জন্য ৬০ জন আর বাকি ২৫ জন চা বাগান ও অন্যান্য জায়গায়। নিয়োগ করা হয়েছে ‘পৃষ্ঠা প্রমুখ’, যাঁরা একেবারে বুথ স্তর পর্যন্ত ভোটারদের সঙ্গে নিত্য ব্যক্তিগত যোগাযোগ রেখেছেন।

আরও পড়ুন: কর্নাটকে জিতছিই, পরের লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ: অমিত শাহ

৭) নিয়োগ করা হয়েছে রেল প্রচারক। যা ভারতের অন্য কোনও রাজ্যে এর আগে প্রয়োগ করা হয়নি। রেলের কামরায় বিজেপির রাজনৈতিক মতাদর্শ তুলে ধরার পাশাপাশি এই প্রচারকেরা ট্রেনযাত্রীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ গড়ে তুলেছেন। এ ভাবে প্রায় ৪০ হাজার যাত্রীর ‘ডেটা বেস’ তৈরি করেছিল বিজেপি।

৮) অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি বা প্রতিষ্ঠান বিরোধী মনোভাবকে অত্যন্ত সুকৌশলে নিজেদের অনুকূলে এনেছে বিজেপি। বিশেষ করে নজর দেওয়া হয়েছে নতুন ও তরুণ ভোটারদের প্রতি।

৯) দীর্ঘ দিনের সংগঠন থাকা সত্ত্বেও সাংগঠনিক জোরেই কিন্তু বাজিমাত করেছে বিজেপি। একান্ত আলোচনায় সিপিএম নেতারা মেনেও নিচ্ছেন যে, একেবারে বুথ স্তর থেকে হয়তো ঠিকঠাক খবর মেলেনি।

বিজেপির এই সাফল্য যে হাওয়ায় আসেনি তা এক বাক্যে মেনে নিচ্ছে রাজনৈতিক মহল।

এবং এ হেন সাফল্যের পরেও যে বিজেপি নেতৃত্ব সংযত আচরণই প্রত্যাশা করেন তা শনিবার হিমন্ত বিশ্বশর্মার কথা থেকেও স্পষ্ট। এ দিন তিনি দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে বলছিলেন, আনন্দ করুন, কিন্তু দেখবেন তা যেন অন্যদের অসুবিধার কারণ না হয় ওঠে।

যে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে ‘চলো পাল্টাই’ স্লোগান তুলেছিল বিজেপি, সেই স্বপ্নপূরণ কতটা হবে তা ভবিষ্যৎই বলবে। কিন্তু আপাতত গেরুয়া ঝড়ে টালমাটাল ত্রিপুরা তথা গোটা দেশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement