জওহরলাল নেহরু এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। ফাইল চিত্র।
সময়টা ১৯৪৭। তখনও কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্দিষ্ট হয়নি। এক দিকে ভারত, অন্য দিকে পাকিস্তান, দৌত্যের কাজে মাউন্টব্যাটেন আর জম্মু ও কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিংহ, এই ছিল সেই ভবিষ্যৎ ঠিক করার চারটি নির্দিষ্ট বিন্দু। শুধু কাশ্মীরই নয়, দেশের আরও বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য শেষ পর্যন্ত কার অধীনে যাবে, তা নির্দিষ্ট করতে তখন চলছে যুদ্ধকালীন তৎপরতা। নেহরু-পটেল আর জিন্না-লিয়াকত আলি, রোজ চলছে বার্তা আদানপ্রদান। ঠিক কী কথা চালাচালি হয়েছিল তাঁদের মধ্যে, তাই নিয়ে বেশ কিছু নতুন তথ্য সামনে আনল রাজেন্দ্র সারিনের বই, ‘পাকিস্তান-দ্য ইন্ডিয়া ফ্যাক্টর’।
কাশ্মীরের পাশাপাশি তখন ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে চূড়ান্ত দর কষাকষি চলছে হায়দরাবাদ আর জুনাগড় নিয়েও। এই বইটিতে সেই সময়ে সর্দার বল্লভভাই পটেল আর পাকিস্তানের মন্ত্রী সর্দার আব্দুল রব নিস্তারের একটি কথোপকথন সামনে আনা হয়েছে। বইটির দাবি, সেখানে পাকিস্তানের মন্ত্রীকে সর্দার পটেল বলেছিলেন, ‘ভাই, হায়দরাবাদ আর জুনাগড় নিয়ে কথা বলা ছেড়ে দিন। কাশ্মীর নিয়ে কথা বলুন। দরকারে কাশ্মীর নিন। একটা রফায় আসুন।’
বিষয়টা অবশ্য এখানেই শেষ হয়নি। কাশ্মীর নিয়ে পটেলের এই মনোভাবের কথা পাকিস্তানের শীর্ষ নেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে উদ্যোগী হন খোদ মাউন্টব্যাটেন। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলির সঙ্গে মাউন্টব্যাটেনের একটি আলোচনায় হাজির ছিলেন সেই দেশের সংবিধান পরিষদের সদস্য সর্দার শওকত হায়াত। সেই বৈঠকেই পটেলের বক্তব্য লিয়াকত আলিকে বলেছিলেন মাউন্টব্যাটেন। এর পরই শওকত হায়াতকে উদ্দেশ্য করে পাক প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি গর্জে উঠে বলেছিলেন, ‘আপনাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে? পঞ্জাবের থেকেও বড় হায়দরাবাদের মতো রাজ্যের দাবি ছেড়ে আমরা কাশ্মীরের মতো পাথুরে জমি নিয়ে রফায় আসব?’
আরও পড়ুন: কালি-৫০০০: পাকিস্তান তো বটেই, কেন চিনও উদ্বিগ্ন ভারতে তৈরি এই যুদ্ধাস্ত্রে
এ ছাড়াও কাশ্মীর নিয়ে ভারতের নমনীয় ভাব দেখানোর আরও বেশ কিছু ঘটনার কথা বলা হয়েছে এই বইতে। পটেলের বিশ্বস্ত সঙ্গী এবং ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব ভিপি মেননের বক্তব্যেও মিলছে সেই ইঙ্গিত। ১৯৪৭ সালের জুনে কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিংহ এবং মাউন্টব্যাটেনের বৈঠকে তিনি হাজির ছিলেন। সেখানে মাউন্টব্যাটেন হরি সিংহকে বলেছিলেন, ‘আপনি পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ভারত কোনও বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। খোদ সর্দার পটেলের কাছ থেকে আমি এই নিশ্চয়তা পেয়েছি।’
এ ছাড়া সর্দার প্যাটেলের তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব ভি শঙ্করের বক্তব্যেও পাওয়া যাচ্ছে পটেলের নমনীয় ভূমিকার কথা। ১৯৭৪ সালে একটি বইতে তিনি সর্দারের একটি মন্তব্য সামনে এনেছিলেন। সেখানে পটেল বলেছিলেন,‘জম্মু ও কাশ্মীরের মহারাজা যদি মনে করেন, পাকিস্তানে যোগ দিলে ভাল হবে, তা হলে আমি বাধা হয়ে দাঁড়াব না।’
আরও পড়ুন: মাসুদ আজহার কোনও মৌলানা নন, উনি এক জন শয়তান, বললেন আসাদউদ্দিন ওয়াইসি
কাশ্মীরের মহারাজা যখন দোলাচলে তখন স্বাধীনতার সময় কাশ্মীরকে মুসলিম প্রাধান্যের রাজ্য হিসেবে দেখতে এবং দেখাতে চাইছিল পাকিস্তান। অন্য দিকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ এবং কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদী’ আন্দোলন গড়ে তুলছিলেন জনপ্রিয় নেতা শেখ আবদুল্লা। আবদুল্লার এই গণতান্ত্রিক আন্দোলন দেখেই বিভ্রান্তিতে পড়ে গিয়েছিলেন নেহরু, এমনটাই দাবি করা হয়েছে এই বইতে। এই বিভ্রান্তি থেকেই অক্টোবর মাসে পুরো বিষয়টি রাষ্ট্রপুঞ্জে নিয়ে চলে যান তিনি। কাশ্মীর ইস্যুকে দ্বিপাক্ষিক থেকে আন্তর্জাতিক করে তোলেন তিনি। পাশাপাশি নিজে থেকেই অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে ঘোষণা করে দেন, গণভোটের মাধ্যমেই কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ ঠিক করা হবে।
নেহরুর এই সিদ্ধান্তের পিছনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন মাউন্টব্যাটেন। অক্টোবরের ২২ তারিখে স্থানীয় উপজাতিদের সঙ্গে নিয়ে কাশ্মীর দখল করতে শুরু করে দিয়েছিল পাকিস্তান সেনা। এই আক্রমণ থেকে কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিংহকে বাঁচাতে শুরুতে চুপ করেই ছিল ভারত। পাঁচ দিন কাটার পর পটেলের পরামর্শে কাশ্মীরে সেনা অভিযান চালাতে রাজি হন নেহরু। কিন্তু ততক্ষণে জট আরও পেকে গিয়েছে। মাউন্টব্যাটেনের পরামর্শে তড়িঘড়ি গণভোটের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা এবং রাষ্ট্রপুঞ্জে অভিযোগ জানানো সেই জটকেই আরও জটিলতর করে তোলে, যা জারি আছে আজও।