প্রাথমিকে নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে তা মেনে নিল পর্ষদ। প্রতীকী ছবি।
প্রাথমিকে নিয়োগে যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টে তা মেনে নিল রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদই।
কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে যে সমস্ত প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি গিয়েছিল, তাঁদের মধ্যে দু’জন কী ভাবে চাকরি পেয়েছিলেন, তার কোনও জবাব প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ সুপ্রিম কোর্টে দিতে পারেনি। সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসু ও বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়ার বেঞ্চে পর্ষদ এ দিন মেনে নিয়েছে, ওই দু’জনের নিয়োগের সমর্থনে কিছু বলা যায় না। তা শুনে বিচারপতি ধুলিয়ার মন্তব্য, এতে প্রাথমিকে নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগই জোরদার হয়।
২০১৪ সালের টেট পরীক্ষায় বাংলা মাধ্যমের পরীক্ষায় একটি প্রশ্নে ভুল ছিল বলে বাড়তি এক নম্বর দেওয়া হয়েছিল। সিবিআই সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছিল, কলকাতায় দু’জন উর্দু মাধ্যমের পরীক্ষার্থী বাংলা মাধ্যমে পরীক্ষা না দিলেও বাড়তি এক নম্বর পেয়ে চাকরি পেয়েছিলেন। পর্ষদের আইনজীবী জয়দীপ গুপ্তের দাবি, ‘‘২৭০ জনের মধ্যে দু’জন ছাড়া সকলেই চাকরি পাওয়ার যোগ্য। দু’জনের ক্ষেত্রে খুব সম্ভবত ভুল হয়ে থাকতে পারে। অথবা আরও অন্য কিছু থাকতে পারে। তা নিয়ে তদন্ত চলছে।’’ বিচারপতি ধুলিয়া মন্তব্য করেছেন, ‘‘এটা শুধু ভুল নয়।’’
যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি না পাওয়া মামলাকারীদের তরফে আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য আজ সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ তুলেছেন, প্রাথমিক শিক্ষক পদে নিয়োগের সময়ে দু’হাজারের মতো পদ রেখেই দেওয়া হয়েছিল ‘বিক্রি’ করা হবে বলে। মোট ৪২,৯৪৯টি শূন্যপদ ছিল। ৪০,৪০০ শূন্যপদ পূরণের পরে নিয়োগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ৬০ হাজার টেট-উত্তীর্ণ প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও বাকি হাজার দুয়েক পদ পূরণ না করার সিদ্ধান্ত কবে, কোথায় হয়েছে, পর্ষদ তার কোনও উত্তর দিতে পারছে না।
বিকাশরঞ্জন বলেন, ‘‘গোটা প্রতারণার খেলায় পর্ষদ নিজেই একজন খেলোয়াড়।’’ বিচারপতিরা বলেছেন, পর্ষদের আইনজীবীকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। পর্ষদের আইনজীবীর বক্তব্য, সিবিআই পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মানিক ভট্টাচার্যকে অক্টোবরে গ্রেফতার করেছে। তিনি এখন ‘পিকচার’-এ নেই। এখন পর্ষদ নথিপত্র অনুযায়ী এগোচ্ছে।
প্রশ্নপত্রে ভুল ছিল বলে টেট পরীক্ষায় বাড়তি এক নম্বর দিয়ে ২৭০ জনকে পরে চাকরি দেওয়া হয়েছিল। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে এঁদের চাকরি যায়। তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। ওই চাকরিহারাদের হয়ে আজ আইনজীবী পি এস পাটওয়ালিয়া ও মীনাক্ষি অরোরার যুক্তি, সিবিআই সাত মাস আগে পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মানিক ভট্টাচার্যকে গ্রেফতার করেছে। এত দিন পরে সিবিআই সুপ্রিম কোর্টে যে রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে টাকার লেনদেন সম্পর্কে একটি শব্দও নেই। অথচ পাঁচ বছর চাকরি করার পরেও দুর্নীতির অভিযোগে ২৭০ জনের চাকরি চলে গিয়েছে। যে ওএমআর শিটে গরমিলের অভিযোগে ২৭০ জনের চাকরি খারিজ করেছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি, তার ভিত্তিতেই তিনি কী ভাবে ১৮৬ জনকে চাকরিতে বহাল করলেন? তাঁদের দাবি, এই চাকরি খারিজ করা বেআইনি। ২৭০ জন যোগ্যতামানের তুলনায় এক নম্বর কম পেয়েছিলেন। পর্ষদ এক নম্বর বেশি দেওয়ায় তাঁরা টেট-উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি পেয়েছিলেন। দুর্নীতি বা টাকার লেনদেন হয়নি।
সিবিআই সুপ্রিম কোর্টকে দেওয়া রিপোর্টে জানিয়েছিল, অনেকেই টেট পরীক্ষায় যোগ্যতামানের তুলনায় অনেক কম নম্বর পেয়েও চাকরি পেয়েছেন। তাঁরা এক নম্বর বাড়তি পেলেও টেট-উত্তীর্ণ হওয়ার কথা নয়। পাটওয়ালিয়া বলেন, ২৭০ জনের মধ্যে উর্দু মাধ্যমের দু’জন বাদ দিলে বাকিরা এর মধ্যে পড়েন না। পর্ষদের আইনজীবী জয়দীপ গুপ্ত তাঁকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, এই ২৭০ জন চাকরি পাওয়ার যোগ্য। বাকিদের ক্ষেত্রে ভুল হয়েছিল নাকি আরও বেশি কিছু হয়েছিল, তা নিয়ে তদন্ত চলছে।
সিবিআইয়ের আইনজীবী হিসেবে অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল এস ভি রাজু বলেন, কাদের চাকরি গিয়েছে, কাদের যায়নি, তা নিয়ে সিবিআই বাছবিচার করছে না। বিচারপতিরা মন্তব্য করেন, সেটা ঠিক। কারণ সিবিআই ‘ম্যাক্রো লেভেল’-এ তদন্ত করছে। রাজু বলেন, ‘‘আমরা ম্যাক্রো বা মাইক্রো নয়, ন্যানো লেভেলে তদন্ত করছি৷’
বিকাশরঞ্জন প্রশ্ন তুলেছেন, পর্ষদই বলছে, ২৭৮৭ জন তাঁদের কাছে জানিয়েছিলেন, তাঁরা এক নম্বর বাড়তি পাওয়ার যোগ্য। এ নিয়ে তাঁদের কাছে আবেদন জমা পড়েছিল। এঁদের মধ্যে থেকে ২৭০ জনকে চাকরি দেওয়া হয়। তাঁরা কী ভাবে জানলেন যে তাঁরা টেট-উত্তীর্ণ হওয়ার নম্বরের থেকে এক নম্বর কম পেয়েছেন? কে তাঁদের বলল? এ নিয়ে কারও কাছে এক টুকরো কাগজ থাকলে দেখানো হোক। পর্ষদের কাছে যে আবেদন জমা পড়েছিল, তা দেখানো হোক। পর্ষদের আইনজীবী জানান, জেলা প্রাথমিক পরিষদের কাছে এ সব আবেদন জমা পড়েছিল। বিকাশ বলেন, পর্ষদ নিজেই বলেছে, তাঁদের কাছে আবেদন জমা পড়ে। বাড়তি নম্বরের দাবিতে বিক্ষোভ হয়। তার পরেই জরুরি বৈঠক ডেকে বাড়তি এক নম্বর দেওয়ার সিদ্ধান্ত। বৃহস্পতিবারও এই মামলার শুনানি চলবে।