বুধবার রাজ্যসভায় বিবৃতি দিলেন অরুণ জেটলি। পিটিআইয়ের তোলা ফাইল চিত্র।
কংগ্রেস চেয়েছিল নিঃশর্ত ক্ষমা চান প্রধানমন্ত্রী তথা সরকার পক্ষ। ক্ষমা সরকার চাইল না। কিন্তু গুজরাতে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী যে ‘পাকিস্তানি চক্রান্ত’ তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন এবং তথাকথিত সেই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যে ভাবে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মনমোহন সিংহের নাম জড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই অবস্থান থেকে সরকার পিছু হঠল।
রাজ্যসভার নেতা তথা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বুধবার বিবৃতি দিলেন রাজ্যসভায়। বললেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নিজের ভাষণে দেশের প্রতি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বা প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির দায়বদ্ধতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলেননি। এমন কোনও ধারণা তৈরি হয়ে থাকলে তা ভুল।’’ জেটলি আরও বললেন, ‘‘এই নেতাদের প্রতি এবং তাঁদের দায়বদ্ধতার প্রতি আমাদের উচ্চ শ্রদ্ধা রয়েছে।’’
গুজরাতে বিজেপি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে এবং কংগ্রেসের আহমেদ পটেলকে মুখ্যমন্ত্রী করতে পাকিস্তান ষড়যন্ত্র করছে— নির্বাচনী প্রচারের এমনই অভিযোগ করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা মনমোহন ক্যাবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মণিশঙ্কর আইয়ারের বাড়িতে একটি ‘গোপন বৈঠক’ হয়েছে বলেও মোদী দাবি করেন। পাকিস্তানের প্রাক্তন বিদেশ মন্ত্রী খুরশিদ মেহমুদ কাসুরি, ভারতে নিযুক্ত এক পাক কূটনীতিক, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি সে বৈঠকে ছিলেন বলে মোদী দাবি করেন।
আরও পড়ুন
কাশ্মীরে ‘কাঁটা’ সরাতে কলকাতা, দিল্লিতে যুদ্ধের হুমকি আল কায়দার
মণিশঙ্কর আইয়ারের বাড়িতে কাসুরি, মনমোহন, আনসারিরা যে গিয়েছিলেন, সে কথা কংগ্রেস অস্বীকার করেনি। কিন্তু ষড়যন্ত্রের অভিযোগ নস্যাৎ করে দেয় কংগ্রেস। কাসুরির সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন মণিশঙ্কর এবং মনমোহন সিংহ, হামিদ আনসারিরা সেখানে নিমন্ত্রিত ছিলেন, জানানো হয় কংগ্রেসের তরফে। পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মনমোহন সিংহ ষড়যন্ত্র করছেন বলে যে মন্তব্য মোদী করেছেন, তার তীব্র নিন্দা করা হয় কংগ্রেসের তরফে। মোদীকে ক্ষমা চাইতে হবে অথবা মনমোহন সিংহের দেশভক্তিকে স্বীকৃতি দিয়ে রাজ্যসভায় প্রস্তাব পাশ করাতে হবে, এমন দাবিও তোলা হয় কংগ্রেসের তরফ থেকে।
সরকার পক্ষ কংগ্রেসের দাবি না মানায় সংসদ চালানো কঠিন হয়ে উঠেছিল। বুধবার সকাল থেকে দফায় দফায় রাজ্যসভায় বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে কংগ্রেস। মনমোহন সিংহের পক্ষ নিয়ে সরব হয় অন্য বিরোধী দলগুলিও। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শেষ পর্যন্ত পিছু হঠার পথই নিল সরকার। প্রধানমন্ত্রী মোদী ক্ষমা চাননি, দুঃখপ্রকাশও করেননি। কিন্তু মোদী ক্যাবিনেটের ‘নাম্বার টু’ তথা রাজ্যসভার নেতা অরুণ জেটলি বিবৃতি দেন। দেশের প্রতি মনমোহন সিংহ এবং হামিদ আনসারির দায়বদ্ধতার প্রতি তাঁরা পূর্ণ মাত্রায় শ্রদ্ধাশীল, বলতে বাধ্য হন জেটলি।
আরও পড়ুন
কুলভূষণের সঙ্গে দেখা করার আগে খোলা হয় মঙ্গলসূত্র, জুতোও লোপাট!
বিজেপি-র নমনীয় মনোভাবের পর সুর খানিকটা নরম করেছে কংগ্রেসও। জেটলির এই মন্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেস সাংসদ গুলাম নবি আজাদ বলেছেন, “রাজ্যসভার নেতার এই ভাবাবেগকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।’’ কংগ্রেসও প্রধানমন্ত্রী পদের অবমাননা চায় না। সেই কারণেই গুজরাতে নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন মণিশঙ্কর আইয়ারের যে বিতর্কিত মন্তব্য সামনে এসেছিল, কংগ্রেস সেই মন্তব্যকে অনুমোদন করেনি বলে আজাদ এ দিন জানান। এ প্রসঙ্গে মণিশঙ্করের নাম তিনি করেননি। কিন্তু মণিশঙ্করকে বহিষ্কার করে রাহুল গাঁধী যে প্রধানমন্ত্রী পদের অবমাননাই রুখতে চেয়েছিলেন, সে কথা আজাদ স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
১৫ ডিসেম্বর শীতকালীন অধিবেশন শুরু হওয়ার পর থেকেই কংগ্রেসের বিক্ষোভ-প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে সংসদের দুই কক্ষ। বার বার তা মুলতুবি হয়েছিল। এ দিন অরুণ জেটলির বিবৃতির পর তাকে স্বাগত জানিয়েছে কংগ্রেস। ফলে সংসদের অচলাবস্থা কাটতে চলেছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক মহল।
এই ধরনের খবর আপনার ইনবক্সে সরাসরি পেতে এখানে ক্লিক করুন
এর পিছনেও রয়েছে চার নেতার প্রচেষ্টা। সরকারের তরফে এতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন বিজেপি নেতা তথা সংসদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বিজয় গয়াল। সূত্রের খবর, গত সপ্তাহে প্রথমে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বাসভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন গয়াল। নরেন্দ্র মোদী যে মনমোহন সিংহের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেননি— এমনটাই জানান তিনি। অপর দিকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীও সংসদের কাজকর্ম স্বাভাবিক রাখায় উৎসাহী ছিলেন। মনে করা হচ্ছে, ওই বৈঠকের পরই বেরিয়ে আসে ‘সমাধানসূত্র’। এর পর অরুণ জেটলির জন্য একটি বিবৃতিও তৈরি করেন বিজয় গয়াল। যাতে সায় দেন জেটলি স্বয়ং। তবে তাতে বেঁকে বসেন কংগ্রেসের আনন্দ শর্মা ও গুলাম নবি আজাদ। পাশাপাশি, কংগ্রেসের তৈরি করা বিবৃতিও খারিজ করে দেয় বিজেপি। এর পর গত শনিবার গুলাম নবি আজাদের বাড়িতে পৌঁছন জেটলি ও গয়াল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আনন্দ শর্মাও। দীর্ঘ ক্ষণ বৈঠকের পর সেখানেই দু’তরফের বিবৃতি তৈরি করা হয়। তাতে রাজি হয় সরকার ও বিরোধী— দু’পক্ষই। তবে এ দিন সকালে সংসদের অধিবেশনের আগে পর্যন্ত তা নিয়ে গড়িমসি দেখাতে থাকে দু’পক্ষ। এর পর রাজ্যসভার চেয়ারম্যান বেঙ্কাইয়া নাইডু মধ্যস্থতা করেন। দু’পক্ষকেই নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য মিটিয়ে নিতে বলেন তিনি। এর পর এ দিন রাজ্যসভায় নিজেদের বিবৃতি পড়ে শোনায় বিজেপি ও কংগ্রেস।