নোট বাতিলের বিরুদ্ধে মামলায় মঙ্গলবার একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট ও কলকাতা হাইকোর্টে তোপের মুখে পড়ল নরেন্দ্র মোদী সরকার। আজ হুঁশিয়ারির সুরে শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, নোট বাতিলের ফলে পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে উঠেছে। কেন্দ্র দ্রুত পদক্ষেপ না করলে হাঙ্গামা (রায়ট) হতে পারে। এ নিয়ে যে কোনও আদালতে যাওয়ার অধিকার মানুষের আছে। এ দিনই নোট বদলের ফলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে মানুষের হয়রানি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে কলকাতা হাইকোর্টে। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য সরকারের আদৌ কোনও পরিকল্পনা আছে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে
দুই আদালতই।
নোট বাতিলের বিরুদ্ধে চারটি জনস্বার্থ মামলার শুনানি চলছে প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুরের বেঞ্চে। তা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন হাইকোর্ট ও নিম্ন আদালতে নোট বাতিলের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কাল শীর্ষ আদালতে নতুন এক আর্জি পেশ করে কেন্দ্র জানায়, এই শুনানি কেবল শীর্ষ আদালতেই হওয়া উচিত। কারণ নানা আদালতে মামলা হলে বিভ্রান্তি হবে।
কিন্তু প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ আজ কেন্দ্রের ওই যুক্তি মানতে রাজি হয়নি। বেঞ্চ সরাসরি জানায়, পরিস্থিতি গুরুতর। হয়রানির জেরে মানুষ বিরক্ত। দ্রুত পদক্ষেপ না করলে গোলমাল হবে। এই অবস্থায় আদালতে যাওয়ার অধিকার মানুষের আছে। বেঞ্চের প্রশ্ন, ‘‘পুরনো নোটের বদলে নতুন নোট নেওয়ার মাত্রা ২ হাজারে নামিয়ে আনা হল কেন? তাহলে কি বুঝতে হবে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য সরকারের কোনও পরিকল্পনা ছিল না?’’
অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগি অবশ্য বেঞ্চকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, হয়রানি কমাতে যথাসাধ্য করছে সরকার। তিনি জানান, নোট ছাপানোর পরে দেশের নানা প্রান্তে তা পৌঁছে দিতে হচ্ছে। নতুন ছাপানো নোটের সঙ্গে এটিএমগুলিকে এখনও খাপ খাওয়ানো যায়নি। তবে টাকার ভাঁড়ারে ঘাটতি নেই। নোট বদলের মাত্রা ২ হাজারে বেঁধে দেওয়া হলেও কৃষকেরা ব্যাঙ্ক থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত তুলতে পারবেন। বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য আড়াই লক্ষ টাকা অবধি তোলা যাবে। পরিস্থিতি অনেকটা শুধরে গিয়েছে বলেও জানান রোহতগি। তিনি বলেন, ‘‘এখন আর মানুষকে ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে না। প্রয়োজনে মাননীয় প্রধান বিচারপতি মধ্যাহ্নভোজের সময়ে বেরিয়ে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে আসতে পারেন।’’
জবাবে আবেদনকারী আদিল আলভির আইনজীবী ও কংগ্রেস নেতা কপিল সিব্বল জানান, পরিস্থিতি সামলাতে যে পরিমাণ নোট ছাপতে হবে তা করার সামর্থ্য কেন্দ্রের নেই। আবার ইতিমধ্যেই সরকার বিপুল পরিমাণ টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে। কোন আইনে করা হয়েছে সেটাও স্পষ্ট নয়। হিমাচলপ্রদেশের প্রত্যন্ত এলাকা, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, মাওবাদী অধ্যুষিত বস্তারে এটিএমে যেতে লোকজনকে ২০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হচ্ছে।
কপিলের কথার মধ্যেই রোহতগি বলেন, ‘‘আপনার সাংবাদিক বৈঠকও দেখেছি। আদালতকে আপনি রাজনীতির মঞ্চ করে ফেলছেন।’’
কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি গিরীশ গুপ্তের বেঞ্চেও আজ নোট বাতিল নিয়ে দু’টি জনস্বার্থ মামলার শুনানি হয়। সেখানে আইনজীবী রমাপ্রসাদ সরকার জানান, প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি, বেসরকারি হাসপাতালে পুরনো ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোট চলছে না। মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। মানুষ ব্যাঙ্ক, ডাকঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়ে টাকা তুলবে না চিকিৎসা করাবে! তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কেন বেসরকারি হাসপাতাল বা প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিগুলিকে আরও কিছু দিন পুরনো ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোট নিতে কেন্দ্র বাধ্য করবে না?’’
তা শুনে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘অনেক জায়গায় অনলাইন পেমেন্ট হয়, ডেবিট কার্ডেও চিকিৎসা খরচ মেটানো যায়।’’ তা শুনে রমাপ্রসাদ জানান, গরিব মানুষের অনেকেরই ডেবিট কার্ড নেই। অনলাইনেও খরচ মেটাতে জানেন না। চিকিৎসার খরচ মেটাতে ৮ নভেম্বরের আগে তাঁরা ব্যাঙ্ক বা ডাকঘর থেকে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট তুলে রেখেছিলেন। এখন বিপাকে পড়েছেন। ব্যাঙ্ক, ডাকঘরে তাঁদের এত টাকা নেই যে ফের নতুন নোট তুলতে পারেন।
আইনজীবী আকবর আলি জানান, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের প্রতিনিধিরা যাতে নোট বদল করতে পারেন তার ব্যবস্থা করুক কেন্দ্র। প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন তোলেন, ‘‘প্রতিনিধিত্ব যে সঠিক হবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? নিশ্চয়তা কে দেবে?’’
অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল কৌশিক চন্দ বোঝানোর চেষ্টা করেন মানুষের দুর্ভোগ মেটাতে পরিস্থিতির উপরে নজরদারি চলছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী নতুন নিয়ম তৈরি হচ্ছে। যা শুনে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘নিত্য নতুন নিয়ম। তার মানে কী করে পরিস্থিতি সামলানো হবে আগে থেকে তার কোনও প্রস্তুতি নেই! কর্তৃপক্ষকে অবস্থা বুঝে মাথা খাটিয়ে ঠিক মতো ব্যবস্থা নিতে হবে।’’ অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেলের উদ্দেশে তাঁর মন্তব্য, ‘‘যাঁদের হিসেব বহির্ভূত টাকা রয়েছে, তাঁদের পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছেন। সাধারণ মানুষের
কী হবে?’’
হাইকোর্টের মতে, অনেক গরিব মানুষের ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট নেই। দিনমজুর, মোটবাহকদের অধিকাংশই করের আওতার বাইরে। সপ্তাহে নোট বদলের সীমা ২০০০ টাকা পর্যন্ত। আটা, সব্জি কিনতেই তো ওই টাকা খরচ হয়ে যায়। প্রধান বিচারপতি গিরীশ গুপ্তের মন্তব্য, ‘‘মানুষের কী করে চলবে? ক’জনের প্যান কার্ড, আধার কার্ড রয়েছে। ওই সব না থাকলে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলা যায় না। আমার গাড়ির চালকই ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেননি!’’