বন্ধ দরজার সামনে হয়তো ওঁরা বলতেন, ‘বিচার চাই’

লখনউয়ে গোমতী নগরে যে নতুন হাইকোর্ট ভবন তৈরি হয়েছে, তার পাশে পুরনো হাইকোর্ট বিল্ডিং এমনিতেই অনেক ম্যাড়ম্যাড়ে। তার মধ্যে এই বন্ধ বাদামি দরজার সামনে পৌঁছে বোঝার জো নেই যে, কত গুরুত্বপূর্ণ মামলা চলছে সেখানে।

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী

লখনউ শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৯ ০৩:৪৮
Share:

নিরাপত্তার ঘেরাটোপে অযোধ্যা।—ছবি রয়টার্স।

“কী চাই?” মোবাইল থেকে মুখ না-তুলেই প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন পাহারায় থাকা পুলিশকর্মী। গাঢ় বাদামি দরজাটার পাশে বার কয়েক ঘুরঘুর করতেই সন্দেহের ভুরু কুঁচকেছিল। পরিচয় জানার পরে সটান পকেটে চলে গেল মোবাইল। চাপা গলায় বললেন, “এমনিতে আসতে কোনও বাধা নেই। কিন্তু এখন দিন তিনেক খুব কড়াকড়ি। উপর মহলের নির্দেশ।” হবে না-ই বা কেন? বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মামলায় এই ঘরেই সিবিআইয়ের বিশেষ আদালতে ঠিক হওয়ার কথা লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলী মনোহর জোশী থেকে শুরু করে তাবড় নেতাদের ভাগ্য!

Advertisement

লখনউয়ে গোমতী নগরে যে নতুন হাইকোর্ট ভবন তৈরি হয়েছে, তার পাশে পুরনো হাইকোর্ট বিল্ডিং এমনিতেই অনেক ম্যাড়ম্যাড়ে। তার মধ্যে এই বন্ধ বাদামি দরজার সামনে পৌঁছে বোঝার জো নেই যে, কত গুরুত্বপূর্ণ মামলা চলছে সেখানে। দরজার মাথায় লেখা: ‘কোর্ট নম্বর-৮’। আবার নীচে সাদা কাগজ সেঁটে লেখা: ‘কোর্ট রুম নম্বর-১৮’। পাশেই দেওয়ালে আর এক সাদা কাগজে জ্বলজ্বল করছে: ‘অযোধ্যা প্রকরণ, লখনউ’।

১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে দায়ের হয়েছিল দু’টি এফআইআর। একটি অজানা, অচেনা অগুনতি কর-সেবকের নামে। যারা মসজিদে তাণ্ডব চালিয়েছিল সে দিন। আর অন্যটি বিজেপি, সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও আরও বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতাদের নামে। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওই কাজে উস্কানি দেওয়ার। অভিযোগ, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রেরও। এই তালিকায় নাম রয়েছে আডবাণী, জোশী, উমা ভারতীর মতো প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর। আছেন উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংহও।

Advertisement

আশপাশের দু’এক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শুনানি হয় কমই। কেন? প্রশ্ন শুনে বিরক্ত চোখে আপাদমস্তক দেখলেন এক আইনজীবী। তবে নরম গলায় বললেন, “এই সমস্ত মামলা কি আর তাড়াতাড়ি শেষ হয়। কত সাক্ষীর বয়স হয়ে গিয়েছে। মারা গিয়েছেন কত জন। অনেকে আবার এলেও স্পষ্ট মনে করতে পারেন না সে দিনের ঘটনা। বোঝেনই তো…।”

এই মামলা এত বছর ধরে ঢিমে তালে কেন চলছে, তা নিয়ে বার বার প্রশ্ন উঠেছে। শীর্ষ আদালতও নির্দেশ দিয়েছে, আগামী জানুয়ারির মধ্যে শুনানি শেষ করে এপ্রিলের মধ্যে রায় ঘোষণার। ২০১৭ থেকে যে কারণে বদলানো বারণ বিচারকও। তা বলে ২৭ বছর পার? সত্যিই কি সাক্ষী জোগাড়ে এত অপটু সিবিআই? তাদের উপরে চট করে কোনও নির্দিষ্ট দলের প্রভাবের তকমা সেঁটে দেওয়াও শক্ত। কারণ, মাঝের এই সিকি শতাব্দীতে কেন্দ্রে কংগ্রেস, বিজেপি— সব দলেরই সরকার এসেছে। লখনউয়ের মসনদও দখল করেছে এসপি, বিএসপি। তা হলে? প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসলেন বয়সের ভারে সামান্য ঝুঁকে পড়া এক আইনজীবী। বললেন, “মামলার গতি কি শুধু পুলিশ, উকিলের হাতে থাকে?”

বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামায় প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ২,০০০ জন। দিনের আলোয় অগুনতি দোকানপাট লুট হয়েছিল। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ঘরবাড়ি।

এঁদের কেউ ওই পুলিশকর্মীর সামনে দাঁড়ালে হয়তো ‘কী চাই’-এর উত্তরে আমার মতো আমতা-আমতা করতেন না।

সম্ভবত বলতেন, “বিচার।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement