প্রতীকী ছবি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর গত কালের বক্তৃতায় ভারতের টিকাকরণের ইতিহাসকে খর্ব করেছেন বলেই মনে করছে বিশেষজ্ঞ শিবির। মোদী গত কাল বলেছেন, ‘‘যদি ভারতের টিকাকরণের ইতিহাসের দিকে তাকানো যায়, দেখা যাবে, দেশকে দশকের পর দশক অপেক্ষা করতে হয়েছে বিদেশ থেকে প্রতিষেধক আসার জন্য। তা সে গুটিবসন্তই হোক, বা পোলিয়ো কি হেপাটাইটিস বি-র টিকা। অন্যান্য দেশে যখন টিকাকরণের কাজ শেষ হয়েছে, ভারতে তখনও তা শুরুই হয়নি।’’
টিকার ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলছে। দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার অনেক আগে থেকে, কোনও প্রতিষেধক আবিষ্কারের কয়েক বছরের মধ্যেই ভারতে তার উৎপাদন শুরু হয়েছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও ছবিটা একই রকম।
২০১২ সালে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চ’ (আইজেএমআর)-এ দেখা যাচ্ছে গুটিবসন্তের প্রতিষেধক ভারতে প্রথম দেওয়া হয়েছিল ১৮০২ সালে! তার মাত্র চার বছর আগে ব্রিটিশ চিকিৎসক ও গবেষক এডওয়ার্ড জেনার এ বিষয়ে তাঁর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছিলেন। ১৮৫০ পর্যন্ত এই টিকা ভারতে আমদানি করা হত, কিন্তু সেটিকে সংরক্ষণ করা ছিল সমস্যার। সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলি কাজ শুরু করে এবং ১৮৯৫ নাগাদ সফল হয়। ভারতে সেই টিকাকরণ শুরু হওয়ার পরে তা কখনওই সে ভাবে বন্ধ হয়নি। তবে তখনকার ভারতীয় সমাজে এই নিয়ে দ্বিধা ও সন্দেহ ছিল। ‘টিকাদার’ (যাঁরা টিকা দিতেন) সংক্রান্ত কিছু সামাজিক সমস্যাও ছিল। অতিমারি বিশেষজ্ঞ এবং ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চ’-এর অন্যতম গবেষক চন্দ্রকান্ত লাহারিয়া বলেন, “এটা ঠিক যে, ১৯৪৪-৪৫ নাগাদ ভারতে টিকাকরণ কমে আসে। সেই সময়ে দেশে সব চেয়ে বেশি গুটিবসন্ত দেখা যায়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক পরেই এই প্রতিষেধকে আবার জোর দেওয়া হয়। গুটিবসন্তে আক্রান্তের সংখ্যাও কমতে থাকে। ১৯৪৭ সালে ভারত গুটিবসন্তের প্রতিষেধক উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়ে ওঠে।”
পরবর্তী কালে এই প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণা হয়েছে, টিকারও পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৫৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘হু’ গোটা বিশ্বকে গুটিবসন্ত-মুক্ত করার মহাপরিকল্পনা নেয়। ‘ইউএস সেন্টার ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল’-এর ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে, ১৯৭১ সালে দক্ষিণ আমেরিকা এবং ১৯৭৫ সালে এশিয়ায় (ভারত-সহ) এই ভাইরাস নির্মূল হয়। তবে প্রতিষেধক না-পাওয়ার কারণে নয়, এই ভাইরাস নির্মূল হতে সময় লেগেছিল বিভিন্ন সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণের জন্য।
ভারতের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস বলছে, এ দেশে পোলিয়োর টিকাকরণের বিষয়টি ছিল বেশ জটিল। আইজেএমআর-এর ২০১৩ সালের সংস্করণে দুই বিজ্ঞানী টি জেকব জন এবং এম বিপিন বশিষ্ঠ বলছেন, ভারত পোলিয়ো-টিকার গবেষণার ক্ষেত্রেও অগ্রণী দেশ। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে এবং মুখে— পোলিয়োর দু’রকম টিকার উৎপাদনই ভারতে গোড়ার দিক থেকেই হয়েছে। পরবর্তী কালে নীতিগত দূরদর্শিতার অভাব এবং সিদ্ধান্তহীনতার কারণে ভারত এ ব্যাপারে শীর্ষ স্থান থেকে সরে যায়, এ কথাও অবশ্য বলেছেন তাঁরা। ১৯৬০ নাগাদ পোলিয়োর টিকা (খাওয়ানোর) তৈরির কাজ শেষ হয় আমেরিকাতে। তার পরে ভারতেও পোলিয়োর নিজস্ব টিকা তৈরি করে পাস্তুর ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া। এর মাঝখানে টিকা আমদানিও হয়েছে। অর্থাৎ ‘দশকের পর দশক’ ভারতকে বসে থাকতে হয়নি।
অনেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ম্যালেরিয়ার জীবাণু নিয়ে রোনাল্ড রস ও কালাজ্বরের ওষুধ নিয়ে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী এ দেশের মাটিতেই সফল গবেষণা করেছিলেন। প্লেগের প্রতিষেধক তৈরি হয়েছিল বম্বে বা অধুনা মুম্বইয়ে, ১৮৯৭ সালে। তখনকার গ্রান্ট মেডিক্যাল কলেজে তা তৈরি করেছিলেন ওয়াল্ডেমার হাফকিন। বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন প্রতিষেধক তৈরির প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে স্বাধীন ভারতেও। যেমন ১৯৪৮ সালে তামিলনাড়ুতে তৈরি হওয়া বিসিজি ল্যাবরেটরি (টিবি-র প্রতিষেধক তৈরির)। এই সব প্রতিষ্ঠানে ডিপথেরিয়া, টিটেনাসেরও প্রতিষেধক তৈরি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, ২০১৪ সালে অর্থাৎ তিনি ক্ষমতায় আসার পরে ‘মিশন ইন্দ্রধনুষ’ দেশের ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ শিশুকে টিকাকরণের আওতায় এনেছে। কিন্তু ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে’-র সাম্প্রতিক ফলাফলে (১৭টি রাজ্য এবং ৫টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে নিয়ে করা সমীক্ষা) দেখা যাচ্ছে, এই হিসেবের কাছাকাছিও যায়নি শিশুদের টিকাকরণের হার। গত বছরের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, মাত্র পাঁচটি রাজ্যে (যার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গও) শিশুদের টিকাকরণের হার ৮০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।