National News

পরের ১৫ অগস্ট এ দেশ তার থাকবে তো? দুরুদুরু বুকেই পতাকা তুলল সেই হায়দর

অসমে দক্ষিণ শালমারার নসকরা নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে হায়দর। গত বছর এই স্বাধীনতা দিবসের সকালেই স্কুলে পতাকা তোলার সময় সে বন্ধু ও শিক্ষকদের সঙ্গে গলা জলে দাঁড়িয়ে স্যালুট করেছিল। সেই ছবি ‘ভাইরাল’ হয়েছিল দেশ জুড়ে।

Advertisement

উজ্জ্বল চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৮ ১৫:০৯
Share:

স্কুলের মাঠে পতাকা তোলা হচ্ছে। বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে হায়দর।

মন ভাল নেই হায়দর আলি খানের। মন ভাল থাকার কথাও নয়। তবুও, সে বুধবার স্কুলে গিয়েছিল। স্বাধীনতা দিবস বলে কথা। স্কুলে পতাকা তোলা হবে যে! তার পর, চকোলেট। কিন্তু, মনটা একেবারেই ভাল নেই তার।

Advertisement

অসমে দক্ষিণ শালমারার নসকরা নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে হায়দর। গত বছর এই স্বাধীনতা দিবসের সকালেই স্কুলে পতাকা তোলার সময় সে বন্ধু ও শিক্ষকদের সঙ্গে গলা জলে দাঁড়িয়ে স্যালুট করেছিল। সেই ছবি ‘ভাইরাল’ হয়েছিল দেশ জুড়ে। কিন্তু, এ বার মনটা ভাল নেই হায়দরের।

সকাল আটটা বাজতে না বাজতেই বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে পৌঁছে গিয়েছিল সে। সারা ক্ষণ মুখটা কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে। স্কুল পরিদর্শক আমির হামজা এবং প্রধান শিক্ষক নৃপেন রাভা যখন পতাকা তুলছেন, নেভি ব্লু হাফ প্যান্ট আর আকাশি জামা পরা হায়দর তখন একদৃষ্টিতে সে দিকেই তাকিয়ে। পতাকা তোলা হতেই সকলের সঙ্গে বলে উঠল, ‘বন্দে মাতরম্’, ‘জয় হিন্দ’, ‘ভারত মাতার জয়’।

Advertisement

স্বাধীনতা দিবসে নসকরা নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের উচ্ছ্বাস।

অথচ, হায়দর নিজে আপাতত ‘দেশহীন’। অসমে নাগরিকপঞ্জির যে খসড়া তালিকা প্রকাশ হয়েছে, সেখানে হায়দরের নাম নেই। তাই মন খারাপ। অথচ চুপচাপ স্বভাবের এই ছেলেটাই সারা ক্ষণ হাসিখুশি থাকে। পতাকা তোলার পর স্কুলশিক্ষক মিজানুর রহমান তাই জিজ্ঞাসাই করে ফেললেন হায়দরকে, ‘‘মনটা বেজার কেন তোমার? চিন্তা কিসের?’’ জবাবটা চটপটই এসেছিল, ‘‘স্যার, নাম ওঠেনি যে। আমার কী হবে?’’

আরও পড়ুন
দেশপ্রেমে মুগ্ধ দেশ, সেই হায়দর এখন নিজেই দেশহীন​

এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে গিয়েছিলেন মিজানুর। একরত্তিকে কী জবাব দেবেন, প্রথমে তাঁরও গুলিয়ে গিয়েছিল। একটু গুছিয়ে নিয়ে বললেন, ‘‘চিন্তা কোরো না। ২০ তারিখ থেকে এ বিষয়ে আবেদনপত্র দেওয়া হবে। ফিল আপ করে জমা দিয়ো। নাম উঠবেই।’’ পাশে তখন দাঁড়িয়ে হায়দরের মা জাইবন খাতুন। চোখের কোণটা আঁচলের খুঁটে মুছে নিয়ে মিজানুরের কথা টেনে ছেলেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।

আরও পড়ুন
গাঁধীর হাতে ঝাঁটা ধরাতে চান মোদী

নাগরিকপঞ্জিতে জাইবনের নাম আছে। আছে হায়দরের দাদা জাইদর এবং তার বোন রিনার নামও। শুধু হায়দরের নাম নেই। কী কারণ, এখনও বোঝা যাচ্ছে না। মিজানুর বলছিলেন, ‘‘এ দিন সকালে স্কুলে পতাকা তোলার সময় বার বার হায়দরের দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল। এই ছেলেটাই গত বছর দেশপ্রেমের প্রতীক হয়ে গিয়েছিল। গলা জলে দাঁড়িয়ে ভারতীয় পতাকাকে ওর স্যালুট করার সেই ছবিটা আমি তুলেছিলাম। ফেসবুকে দেওয়া মাত্রই ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। আর এ বছর, ও নাকি ভারতীয়ই নয়! কোথাও একটা বড়সড় গন্ডগোল হয়েছে।’’

গত বারের ভাইরাল হওয়া সেই ছবি। পতাকা তুলছেন স্কুলের তখনকার প্রধান শিক্ষক তাজেম শিকদার। পাশে স্যালুট করছে হায়দর ও জিয়ারুল।

হায়দরের মা জাইবন শালমারারই একটি স্কুলে মিড ডে মিলের রান্না করেন। মাসে হাজারখানেক টাকা পান। তাই দিয়ে তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে কোনও রকমে সংসার চালান। কষ্টের সেই জীবনে ছোট ছেলেকে নিয়ে নতুন এই বিড়ম্বনা। কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। স্কুলের দ্বারস্থ হয়েছেন। সকলেই আশ্বস্ত করছেন, নাম উঠে যাবে। কিন্তু, যারা আশ্বস্ত করছেন, তাঁরাও জানেন না, সত্যিই হায়দরের নাম উঠবে তো!

নসকরা নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ বারের স্বাধীনতা দিবসের নানা মুহূর্ত।

এ বছর ৩০ জুলাই নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত খসড়া তালিকা প্রকাশ হলে দেখা যায়, গ্রামের অনেকের মতো হায়দরের নামও তালিকায় নেই। হায়দরের মা জানিয়েছেন, এনআরসি সেবা কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে, হায়দরের জন্মের শংসাপত্রে সম্ভবত গোলমাল আছে। সেবা কেন্দ্র সূত্রে বলা হচ্ছে, গ্রামে মহিলাদের অনেকের প্রসবই হাসপাতালে হয় না। পরে জন্মের শংসাপত্র সংগ্রহ করতে যায় পরিবার। তখনই কোনও গোলমাল হয়ে থাকবে।

বছর ছয়েক আগে কোকরাঝাড়ে জঙ্গি হানায় মারা যান হায়দরের বাবা রুপনাল খান। তার পর থেকেই নাকি চুপচাপ হায়দার। ছোট হলেও, নাম বাদ পড়ার গুরুত্ব সে জানে। তাই আরও চুপ হয়ে গিয়েছে।

ছবি: মিজানুর রহমান।

(কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, গুজরাত থেকে মণিপুর - দেশের সব রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে আমাদের দেশ বিভাগে ক্লিক করুন।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement