National News

ডিভাইন শব্দটি রাম রহিমদের মাথায় থাকে না

সন্ন্যাসীরাও রাজাধিরাজের মতো ক্ষমতা চান, এটাই ভারতীয় ঐতিহ্য। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী।ট্র্যাডিশন অবশ্য পুরাকালের। এ দেশে ভণ্ড সন্ন্যাসী কোনও দিনই কম পড়ে নাই। কৌটিল্য থেকে মনু, সকলেই বলেছেন, ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসীকে গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ করলে রাজা শত্রু রাজ্যের খবরাখবর রাখতে পারবেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৭ ১৬:৩৫
Share:

ডেরা সচ্চা সৌদা কি আমাদের ভারতীয় সমাজে আদৌ কোনও ধাক্কা?

Advertisement

ডেরা সচ্চা সৌদা প্রধান গুরমিত রাম রহিমের মতো ধর্ষক ‘বাবা’ অতীতেও ছিলেন, আজও আছেন। বোধ করি, ভবিষ্যতেও থাকবেন! উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ধর্ষণের দায়ে আসারাম বাপু এখনও জেলে। দক্ষিণের এক অভিনেত্রীকে নিয়ে নিত্যানন্দ পরমহংসের সেক্স ভিডিও তৈরির কেচ্ছা এখনও যথেষ্ট ‘হট টপিক’। হরিয়ানার এই পঞ্চকুলাতেই বছর দু’য়েক আগে খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত কবিরপন্থী বাবা রামপালের সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের খণ্ডযুদ্ধ বেধেছিল। পুরো একটি দিন পুলিশের সঙ্গে সমানে টক্কর দেয় রামপালের সমর্থকেরা। পরে পুলিশ আশ্রমে ঢুকতে পারে। রাম রহিম বাবা আবারও বুঝিয়ে দিলেন, সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে!

Advertisement

আরও পড়ুন

আর এক সুপারহিরোর গল্প

ট্র্যাডিশন অবশ্য পুরাকালের। এ দেশে ভণ্ড সন্ন্যাসী কোনও দিনই কম পড়ে নাই। কৌটিল্য থেকে মনু, সকলেই বলেছেন, ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসীকে গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ করলে রাজা শত্রু রাজ্যের খবরাখবর রাখতে পারবেন। ভারতীয় নিয়মেও যোগীরা ‘রমতা সাধু’, মানে তাঁরা সব সময় ভ্রাম্যমাণ থাকবেন, কোনও একটি জায়গায় আবদ্ধ থাকবেন না। অনেকে মিলে সঙ্ঘ করে থাকাটা হিন্দুদের নয়, বৌদ্ধ রীতি। সংসার ত্যাগ করে অনেকে একসঙ্গে থাকলে সেখানে যে ফের সংসারের দোষগুলি দেখা দেবে, সে বিষয়ে ভারতীয়রা অবহিত ছিলেন। মহাভারতে নারদ যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন, চিত্তজয় করতে উৎসুক ব্যাক্তি সন্ন্যাস নিয়ে একাকী বিজনে অবস্থান করবেন, ভিক্ষা করে পরিমিত আহার করবেন। দক্ষ স্মৃতির বক্তব্য: দু’জন সন্ন্যাসী একত্র বাস করলে সন্ন্যাসী মিথুন, তিন জনে সন্ন্যাসী গ্রাম, চার বা ততোধিক জনে সন্ন্যাসী নগর— এ সবই পরিত্যজ্য। অনেক সন্ন্যাসী এবং সন্ন্যাসিনী একত্রে ডেরা বেঁধে থাকলে কী হবে বা হতে পারে, তা সে-কাল ভাবতেও চায়নি।

স্বামী নিত্যানন্দ।

স্বামী নিত্যানন্দ।

হিন্দু ধর্ম তাই সন্ন্যাসী মানেই মহৎ, উদার এ সব ভাবেনি। বেতাল পঞ্চবিংশতির গল্প অনেকের মনে থাকতে পারে। এক সন্ন্যাসী রাজপ্রাসাদে এসে রোজ একটা আস্ত বেল নিয়ে রাজাকে আশীর্বাদ করেন। এক দিন দেখা গেল, বেলের মধ্যে আস্ত একটি মোহর। সন্ন্যাসী বললেন, এই রকম মোহরভর্তি বেল দিয়েই তিনি রাজাকে আশীর্বাদ করেছেন। নৃপতির কাছে তাঁর একটিই প্রার্থনা। তিনি যেন অমাবস্যার রাতে শ্মশানে সন্ন্যাসীর সঙ্গে হাজির হন। শ্মশানে গাছে বাঁধা এক শব। রাজা তাকে নিয়ে আসার চেষ্টা করলেই মৃতদেহ একটি করে গল্প বলে, তার পর পালিয়ে যায়। শেষে শবদেহ জানালে, এই সন্ন্যাসী বিপজ্জনক। এ রাজাকে মারতে চায়। তাই রাজা যেন বলেন, আমি কী ভাবে প্রণাম করব, দেখিয়ে দিন। ভণ্ড সন্ন্যাসী প্রণামের জন্য নিচু হতেই রাজা যেন ওর গলা কেটে দেন। ভারতীয় সাহিত্যের অন্যতম ধ্রুপদী বয়ানেও আছে ক্ষমতালোভী ভণ্ড সন্ন্যাসীর কথা।

আরও পড়ুন

বিশ বছর জেল ধর্ষক ধর্মগুরুর

দেশ জুড়ে আলোড়ন তুলেছিল যে ধর্ষণ মামলাগুলি

এ দেশের সমাজ তাই দুই ভাগে বিভক্ত...গৃহীসমাজ ও সাধুসমাজ। গৃহীসমাজে যেমন চোর, পুলিশ, গুন্ডা, নিপাট সৎ একত্র বাস করে, সাধু সমাজেও সে রকম। আসলি-নকলি, সৎ বাবা ও মছলি বাবা, সকলের সহাবস্থান। গ্রামের দিকে কত যে ধর্ষক বাবা আছে, তা রবীন্দ্রনাথের ‘ঘাটের কথা’ পড়লেই জানা যায়। উনিশ শতকে তারকেশ্বর মন্দিরে মোহান্ত-এলোকেশী সম্বাদ খুব বিখ্যাত হয়েছিল। নবীন নামে এক গৃহস্থ ভদ্রলোক তার বউকে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে খুন করেছিল। কারণ, মন্দিরের দশনামী শৈব মোহান্তর সঙ্গে নবীনের স্ত্রী এলোকেশীর সম্পর্কের কানাঘুষো। ব্রিটিশ আমলেও পুলিশ প্রত্যহ ‘ভবঘুরে এবং সাধু’দের সন্দেহের চোখে রাখত।

আসারাম বাপু।

আসারাম বাপু।

কারণ, ব্রিটিশ জানত, এই সাধুরা কী কী করেন। আজও বড় বড় সব আখড়া কুম্ভমেলায় শাহি স্নানের জৌলুসে, অস্ত্র নিয়ে মিছিলে আমাদের চোখ ঝলসে দেয়। এই সব আখড়া বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক। সুদের ব্যবসা, অস্ত্রের ব্যবসা অনেক কিছুই করত তারা। কখনও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, আবার কখনও দেশীয় রাজাদের ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে কাজ করেছেন এই সব সাধুসন্ত। সন্ন্যাসীরাও রাজাধিরাজের মতো ক্ষমতা চান, এটাই ভারতীয় ঐতিহ্য। গৌতম বুদ্ধকে দেখে ঋষিরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এই শিশু হয় বুদ্ধ হবে, কিংবা রাজচক্রবর্তী। সন্ন্যাসী আসলে যাবতীয় সাংসারিক ক্ষমতার উর্ধ্বে আরও বড় এক দিব্য ক্ষমতা। বিবেকানন্দ তাই সন্ন্যাসীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন divine outlaw. রাম রহিম, আসারামেরা বেআইনি আউটলকেই সর্বেসর্বা করেন, ডিভাইন শব্দ তাঁদের মাথায় থাকে না। এটাই আধুনিকতার নিয়ম!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement