প্যান্ট্রির সংখ্যা কমছে রাজধানীতে, যাত্রী-পরিষেবা বিঘ্নের আশঙ্কা

দিল্লি বহুত দূর। এবং রাজধানী এক্সপ্রেসে সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে গিয়ে চায়ের কাপ আর আদৌ ঠোঁট পর্যন্ত পৌঁছবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি করেছে রেল বোর্ডই। তাতে যাত্রিসাধারণের ক্ষোভের সঙ্গে সঙ্গে বড় হয়ে উঠছে কিছু প্রশ্নও। ঠিক যেমন প্রশ্ন উঠেছিল ওই কুলীন ট্রেন থেকে ফিশফ্রাইয়ের পাট তুলে দেওয়ার পরে। ফিশফ্রাই উঠে যাওয়ায় কৌলীন্য হারিয়েছে হাওড়া ও শিয়ালদহ রাজধানী এক্সপ্রেস।

Advertisement

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৬ ১৫:০৩
Share:

দিল্লি বহুত দূর। এবং রাজধানী এক্সপ্রেসে সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে গিয়ে চায়ের কাপ আর আদৌ ঠোঁট পর্যন্ত পৌঁছবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি করেছে রেল বোর্ডই। তাতে যাত্রিসাধারণের ক্ষোভের সঙ্গে সঙ্গে বড় হয়ে উঠছে কিছু প্রশ্নও।

Advertisement

ঠিক যেমন প্রশ্ন উঠেছিল ওই কুলীন ট্রেন থেকে ফিশফ্রাইয়ের পাট তুলে দেওয়ার পরে। ফিশফ্রাই উঠে যাওয়ায় কৌলীন্য হারিয়েছে হাওড়া ও শিয়ালদহ রাজধানী এক্সপ্রেস। রেল বোর্ডের সাম্প্রতিক এক নির্দেশনামার প্রেক্ষিতে এ বার ট্রেনে গরম চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার মজাটুকুও যাত্রীরা আর পাবেন না বলে আশঙ্কা করছেন রেলকর্তারাই।

কী বলছে সেই নির্দেশনামা?

Advertisement

রেল সূত্রের খবর, সব রাজধানী এক্সপ্রেসেই এখনও পর্যন্ত দু’টি প্যান্ট্রিকার আছে ঠিকই। কিন্তু ২৫ মার্চ থেকে দেশের আটটি রাজধানী এক্সপ্রেসে দু’টির মধ্যে একটি করে প্যান্ট্রিকার তুলে দেওয়া হবে। তবে, পূর্ব রেল হাওড়া ও শিয়ালদহ রাজধানীতে এই আদেশ কার্যকর করবে ২৮ মার্চ, সোমবার থেকে। একটি প্যান্ট্রিকার তুলে দিয়ে সেই জায়গায় দেওয়া হবে তৃতীয় শ্রেণির একটি বাড়তি বাতানুকূল কামরা। এতে দ্বিমুখী সুরাহা দেখছে রেল। ওই নির্দেশনামায় বোর্ডকর্তারা বলেছেন, এতে রেলের আয় বাড়বে। আবার প্রতিটি রাজধানী এক্সপ্রেসে অতিরিক্ত কিছু যাত্রী আসন সংরক্ষণ ও ভ্রমণের সুযোগ পাবেন। হাওড়া, শিয়ালদহ ছাড়া বাকি রাজধানী এক্সপ্রেসগুলি হল নয়াদিল্লি-মুম্বই, নয়াদিল্লি-আমদাবাদ, হজরত নিজামুদ্দিন-মুম্বই, নয়াদিল্লি-গুয়াহাটি, নয়াদিল্লি-ডিব্রুগড় এবং নয়াদিল্লি-পটনা।

একটি প্যান্ট্রিকার তুলে নিলে কেন পাওয়া যাবে না চা?

রাজধানী এক্সপ্রেসের মোট দু’টি প্যান্ট্রিকারের একটি থাকে সামনে এবং অন্যটি পিছনে। প্রতিটি প্যান্ট্রিতে গরম জল তৈরির জন্য বয়লার থাকে তিনটি। তাতে জল গরম করতে লাগে তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টা। ওই তিনটি বয়লারে যে-পরিমাণ জল গরম করা যায়, তা দিয়ে শ’পাঁচেক যাত্রীকে এক বার চায়ের জল দেওয়া সম্ভব। এত দিন দু’টি প্যান্ট্রিতে জল গরম করে ফ্লাস্কে চায়ের জল দেওয়া হতো যাত্রীদের। কিন্তু একটি প্যান্ট্রিকার তুলে দিলে অন্য প্যান্ট্রির বয়লারে জল গরম করে ১১০০-১২০০ যাত্রীকে সকালে দু’বার চা দেওয়া প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন রেলকর্তারা।

কেন সম্ভব নয়, সেই প্রশ্ন উঠছে। কারণ, যাত্রীদের যে-খাবার দেওয়া হয়, তা তো আসে যাত্রাপথে বিভিন্ন স্টেশনের ‘বেস কিচেন’ থেকে। তা হলে দু’টি প্যান্ট্রিকারের দরকার কী? একটি প্যান্ট্রি চায়ের গরম জল জোগাতেই বা পারবে না কেন?

রেল জানাচ্ছে, একটি প্যান্ট্রিতে বাতানুকূল প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের খাবার তৈরি হয়। তবে সকালে ঠিক সময়ে চা জোগানোর জন্য কিছুটা জল গরম হয় সেখানেও। দ্বিতীয় প্যান্ট্রিতে মূলত তৈরি হয় সকালের জলখাবার। তৈরি হয় চায়ের গরম জল এবং কোনও কোনও যাত্রীর (শিশু এবং অসুস্থ) বিশেষ চাহিদার খাবারও। তা ছাড়া অতিরিক্ত খাবার মজুত করা থাকে প্যান্ট্রিকারে। যাতে কোথাও ট্রেন আটকে গেলে যাত্রীদের দু’বার অতিরিক্ত খাবার বানিয়ে দেওয়া যায়।

এমনিতেই রেলের খাবার নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। খাবারের মান নিয়ে মাঝেমধ্যে গোলমালও হচ্ছে। রাজধানীর মতো ট্রেনে একটি প্যান্ট্রি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ওই গোলমাল বাড়িয়ে দেবে বলে আশঙ্কা করছেন রেলকর্তারা। প্রতিটি রাজধানীতে প্রায় হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। থাকেন শ’‌দেড়েক কর্মী। কামরা (এখন রাজধানীতে কামরা থাকে ২০-২১টি) বাড়লে যাত্রী-সংখ্যাও বাড়বে। মাত্র এক প্রান্তে প্যান্ট্রিকার থাকলে পরিবেশনকারীদের অন্য প্রান্তে যাতায়াত করতে অনেক সময় লাগবে। ফলে যাত্রী-ক্ষোভ বাড়বে।

রেল বোর্ডের নির্দেশে মাথায় হাত পড়েছে রেলওয়ে কেটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্পোরেশন বা আইআরসিটিসি-র কর্তাদেরও। তাঁদের প্রশ্ন, খাবার না-হয় বেস কিচেন থেকে নেওয়া গেল। কিন্তু চা বা কফি? তা ছাড়া চায়ের জলের ফ্লাস্ক এবং অন্যান্য বাসনপত্র ধোয়াধুয়ির জায়গাতেও টান পড়বে। এই সব সমস্যা মিটবে কী ভাবে? সমাধান দেখতে পাচ্ছেন না তাঁরা। রাজধানীর সব প্যান্ট্রির দায়িত্বে আইআরসিটি একা নেই। অনেক রাজধানীতে যাত্রীদের খাবার দেয় বেসরকারি সংস্থা। যেমন শিয়ালদহ রাজধানী। আইআরসিটিসি-র পক্ষে যা সম্ভব, সেটা বেসরকারি সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই রেলের সিদ্ধান্তে তাঁরাই বেশি মুশকিলে পড়বেন বলে আশঙ্কা করছেন ওই সব সংস্থার মালিকেরা। অনেক রেলকর্তার আশঙ্কা, একটি প্যান্ট্রি তুলে দিলে বেসরকারি সংস্থা আদালতে যেতে পারে। কারণ, তাদের নিয়োগের সময় যে-সব শর্ত দেওয়া হয়েছিল, তাতে এ কথা ছিল না।

সমস্যায় পড়বেন রাজধানীর টিকিট পরীক্ষক, ট্রেন সুপার এবং অন্যান্য কর্মীও। ওই ট্রেনে থাকেন রেলসুরক্ষা বাহিনীর জওয়ান এবং খাবার সরবরাহের কর্মীরা। সব মিলিয়ে ৮০-৯০ জন। কাজের শেষে তাঁরা ওই প্যান্ট্রিকারেই শুয়ে-বসে ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রাম করেন। একটি প্যান্ট্রিকার তুলে দিলে তাঁদেরও জায়গা নিয়ে সমস্যা তৈরি হবে। ফলে বিশ্রামের অভাবে কাজের মানও ভাল হবে না বলে রেলকর্তাদের আশঙ্কা।

সর্বাঙ্গীণ অসুবিধা সত্ত্বেও একটি প্যান্ট্রি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন?

জুতসই জবাব মিলছে না। তবে রেল বোর্ডের এই নির্দেশ যাত্রীদের রেল-বিমুখ করে তুলবে বলে মনে করেন প্রাক্তন রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী। তাঁর কথায়, ‘‘রেল দু’রকম কথা বলছে। এক দিকে উন্নত পরিষেবার কথা বলছে। আবার পরিষেবা তুলে নিচ্ছে ঘুরপথে। আসলে আয় বাড়াতে গিয়ে রেল সকলকে বেশি টাকা দিয়ে প্রিমিয়াম ট্রেনে চড়তে বাধ্য করাচ্ছে।’’ এমনিতেই রেলে যাত্রী কমছে। এই সিদ্ধান্তে আরও যাত্রী কমে রেলের রোজগার কমে যাবে বলে মনে করেন প্রাক্তন ওই রেল প্রতিমন্ত্রী।

এটা রেলের তুঘলকি সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন রেলের প্রাক্তন কর্তারাও। তাঁদের কথায়, প্রথমে পরীক্ষামূলক ভাবে একটি ট্রেনে প্যান্ট্রি তুলে দিয়ে পরিস্থিতি যাচাই করে নেওয়া উচিত ছিল। একসঙ্গে সব রাজধানীতে এ ভাবে রাতারাতি একটি প্যান্ট্রি তুলে নিলে যাত্রীদের সঙ্গে গোলমাল বাধতে বাধ্য। ‘‘আয় বাড়াতে যাত্রী-স্বাচ্ছন্দ্যে কোপ বসানো মোটেই ঠিক কথা নয়,’’ বলছেন প্রাক্তন রেলকর্তা সুভাষরঞ্জন ঠাকুর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement