গীতা হরিহরণ ও প্রবীর পুরকায়স্থ। —নিজস্ব চিত্র।
জেল থেকে বেরোনোর পর একাদশ দিন। কথা বলার সুযোগ মিলল।
সংবাদ সংস্থায় বিদেশি অর্থের যোগ ও রাষ্ট্রদ্রোহের ‘অপরাধে’ ২০২৩ সালের অক্টোবরে দিল্লি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন নিউজ়ক্লিকের প্রতিষ্ঠাতা, সাংবাদিক প্রবীর পুরকায়স্থ। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ১৫ মে জামিন পান তিনি, সন্ধেতেই জেল থেকে বেরোন। জীবনসঙ্গী, সাহিত্যিক গীতা হরিহরণ জানিয়েছিলেন, আদালতের নির্দেশ, মামলা সংক্রান্ত কথা বলা যাবে না। জামিন পেয়ে বেরিয়েই তাই কথা বলতে পারছেন না প্রবীর।
আর শনিবার সকালে যখন ফোনে কথা হল, প্রবীর বললেন, তাঁর জেলে থাকাকালীন সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন গীতাই। আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ, মামলা লড়ার টাকা জোগাড়, জামিনের আবেদন — সমস্ত ছোটাছুটি একা করেছেন সত্তর বছরের গীতা। জেলে সপ্তাহে দু’বার দেখা করার অনুমতি মিলত। প্রবীরের কথায়, ‘‘আমার আর কী? আমি তো জেলে চলে গেলাম। আসল লড়াইটা যাঁরা বাইরে থেকে যান, তাঁদের। পরিবারের।’’
শনিবার সকালে ভোট দিয়েছেন প্রবীর-গীতা দু’জনেই। প্রবীণ সাংবাদিক বলছেন, ‘‘গণতান্ত্রিক অধিকার চিরকালই মানুষ অর্জন করে, কেউ দেয় না। অতীতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গণতন্ত্র অর্জন করতে হয়েছে। জরুরি অবস্থার সময়ে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম চলেছে। এখনও দেশের সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করছেন।’’
মামলা নিয়ে কথা বলায় বিধিনিষেধ রয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের। প্রবীর সে নির্দেশ মেনে চলছেন। তবে জানালেন, কী কী যুক্তিতে তাঁর গ্রেফতারি অবৈধ বলে জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট বলেছে— প্রথমত, গ্রেফতারির কারণ নির্দিষ্ট করে ধৃতকে জানানো দরকার। আর যাঁকে গ্রেফতার করা হচ্ছে, তাঁকে গ্রেফতারির কারণ লিখিত ভাবে দেওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, যেখানে আমার আইনজীবীর ফোন নম্বর ছিল ওদের কাছে, সেখানে লিগ্যাল সেল থেকে এক জন উকিলকে নিয়ে সকাল ছ’টায় সময়ে আমাকে পেশ করায় ভুল ছিল। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, আমার নিজের আইনজীবী নিয়োগের অধিকার ছিল। এ আমার সাংবিধানিক অধিকার।’’
ইউএপিএ-ধারায় গ্রেফতারি, সাত মাসের হাজতবাস, মানসিক যন্ত্রণা। অবৈধ গ্রেফতারির রায় কি সেই ক্ষত পূরণ করতে পারবে? হাসলেন প্রবীর, ‘‘ভিক্টিম হওয়াটা পছন্দ করি না। জরুরি অবস্থার সময়েও এক বছর জেলে ছিলাম। ফলে, বিষয়টা নতুন নয়। আমার সঙ্গে কী হয়েছে, তার চেয়েও অনেক বড় বিষয় আজ দেশের সঙ্গে কী হচ্ছে।’’
প্রবীর জরুরি অবস্থা দেখেছেন। এই সময়েও শাসকের বিরুদ্ধে গেলে সাংবাদিক, সমাজকর্মী, শিক্ষক-গবেষকদের জেলে যেতে হচ্ছে। রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। সাংবাদিক হিসেবে দুই সময়ের মধ্যে ফারাক দেখতে পান? উত্তর এল, ‘‘অনেক কিছুই আলাদা। তবে দুই সময়ের মধ্যে একটা মিল যে, মানুষের মনে ভয় তৈরি করা সম্ভব হয়েছে— যদি আমরা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলি, তা হলে নানা আইন আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়।’’ সাংবাদিকের মতে, এর মধ্যে ইউএপিএ অন্যতম। এ ছাড়া, যখনই কেউ সরকার-বিরোধিতা করছেন, ইডি, আয়কর দফতর সক্রিয় হয়ে উঠছে।
প্রবীর বলছেন, ‘‘জরুরি অবস্থার সময়ে সংবাদমাধ্যমে সেন্সরশিপ চালু হয়েছিল। কোনও খবর লিখতে হলে অনুমতি নিতে হত। বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলে প্রিন্টিং প্রেস বন্ধ হয়ে যেত, কাগজ বেরোত না। ইমার্জেন্সির রাতে সেটাই করা হয়েছিল। ইন্টারনেটের যুগে এখন আর তা করা যায় না। কিন্তু দুটো সময়ের উদ্দেশ্য একই— সরকারের সমালোচনা যেন না করা হয়।’’
সরকার-বিরোধী খবরে সাংবাদিকদের গ্রেফতারের ঘটনা মূলস্রোতের সাংবাদিকতায় প্রভাব ফেলছে? প্রবীরের মতে, ‘‘এর প্রভাব যে সংবাদমাধ্যমে পড়েছে, বুঝতে পারি। তবে শাসকদলের বিরোধিতা করলে তাঁর উপরে সরকারের হয়ে সংবাদমাধ্যমেরই একাংশের আক্রমণ, সেটা অনেক বেশি অনৈতিক, অনেক বেশি অসাংবাদিক-সুলভ কাজ।’’
প্রবীর মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এখন কোনও ঘটনা ঘটলে সাধারণ মানুষ সমাজমাধ্যমে লেখেন, ভিডিয়ো তুলে দেন, হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা দেন। অন্য দিকে, সাংবাদিকেরা ভাবনাচিন্তা করে সাবধানে লেখেন। ‘কোড অফ এথিক্স’ মেনে চলেন। সাধারণ মানুষের অত খেয়াল থাকে না। তবে আইনগত দায়িত্ব দু’জনেরই এক।
নিউজ়ক্লিকের প্রতিষ্ঠাতার কথায়, ‘‘সাধারণ মানুষ যে ভুল করে, তা সাংবাদিকের করা উচিত নয়। আগে বলা হত, সাংবাদিকদের কাজ হচ্ছে— ‘টু স্পিক ট্রুথ টু পাওয়ার’। এখন ‘পাওয়ার ইজ স্পিকিং টু ট্রুথ’। সরকার যা বলছে, সেটাকেই আরও বেশি করে প্রচার করছে এবং যারা এর বিরোধিতা করছে, তাদের আক্রমণ করছে। মূলধারার সংবাদমাধ্যমের একাংশ এই কাজ করছে। সংবাদমাধ্যমের উপরে সরকারের প্রভাব চিরকালই ছিল। এখন সেই প্রভাব অনেক বেশি।’’
কারাবাসে লেখালেখি চালিয়ে গিয়েছেন প্রবীর। দশ-বারোটা বই জেলে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। সেগুলো পড়তেন, সঙ্গে লেখা। প্রবীর বলেন, ‘‘ কখন ছাড়া পাব, জেলে কখনও তা ভাবতে হয় না। তা ভাবলে মানুষ অবসাদে চলে যায়। ধরেই নিয়েছিলাম, দুই-আড়াই বছর জেলে থাকতে হবে। সে ভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করেছিলাম। ‘সুগার অ্যান্ড স্লেভারি’ নিয়ে একটা স্টাডি করেছিলাম। আমায় নিয়ে তিন জন অথর। সেই প্রবন্ধ লেখার কাজ জেলেই শেষ করেছি। এখন সেটা প্রকাশের জন্য চলে গিয়েছে।’’
যে কলম রুখতে গ্রেফতারি, সেই কলম জেলেও থামেনি।